ছোট্ট জায়গির থেকে বিশাল সাম্রাজ্য
উসমানিরা ছিল অঘুজ তুর্কি বংশোদ্ভূত।
পূর্ব তুর্কিস্তান ছিল তাদের আদি ভূমি।
উইঘুর মুসলিম অধ্যুষিত এ ভূখণ্ডটি যুগ যুগ ধরে চীনের জবরদখলে থাকা একটি প্রদেশ।
আধুনিক বিশ্ব-মানচিত্রে যা ‘জিনজিয়াং” নামে পরিচিত।
প্রাচীনকালে উসমানিরা বসবাস করত কুর্দিস্তানে।
ছাগল, দুম্বা ও ভেড়া পালন করে জীবনযাপন করত।
কিন্তু যখন ইরাক ও এশিয়া মাইনরের পূর্বাঞ্চলে মোঙ্গল নেতা চেঙ্গিস খানের রক্তপাত বেড়ে যায়,
উসমানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা উসমান বিন এরতুগরুলের দাদা সুলায়মান শাহ তাঁর 'কায়ি’ গোত্রকে নিয়ে ১২২০ খ্রিষ্টাব্দে জীবন বাঁচাতে কুর্দিস্তান থেকে হিজরত করে আনাতোলিয়ার দিকে চলে আসেন।
এখানে এসে ‘আখলাত' নামক অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন।
১২৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সুলায়মান শাহর মৃত্যুর পর ‘কারি’ গোত্রের সর্দার নিযুক্ত হন সুলায়মানের মেজো ছেলে।
একই কারণে এরতুগরুলও তাঁর গোত্রকে নিয়ে ধারাবাহিকভাবে দক্ষিণ- পশ্চিম আনাতোলিয়ার দিকে অগ্রসর হতে থাকেন।
একদিন এরতুগরুল বিন সুলায়মান শাহ তাঁর গোত্রের ১০০টি পরিবারের প্রায় ৪০০ যোদ্ধা নিয়ে তাতারদের উত্তোলিত তরবারি থেকে বাঁচতে ছুটে চলছিলেন।
হঠাৎ করেই কোথাও ঢাল-তলোয়ারের ঝনঝনানি আর ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি শুনতে পান।
একটু কাছে আসতেই দেখেন, মুসলিম ও খ্রিষ্টান দুই দলের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলছে! যুদ্ধে খ্রিষ্টানদের পাল্লা ভারি।
পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে মুসলিম সেনাদল।
ইসলামি ভ্রাতৃত্ববোধ, ধর্মীয় আত্মসম্মান আর ইমানি চেতনা উথলে ওঠে এরতুগরুলের মনের মধ্যে।
গোত্রের যোদ্ধাদের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুসলিমবাহিনীকে সাহায্য করার নির্দেশ দেন তিনি।
গোত্রনেতার ইশারা পাওয়ামাত্র মুহূর্তেই বাজপাখির মতো ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুর্ধর্ষ 'কায়ি' গোত্রের প্রায় চারশ মুসলিম যোদ্ধা ।
মুসলিমবাহিনীর পতাকাতলে সমবেত হয়ে আঘাত হানে খ্রিষ্টানবাহিনীর ওপর।
অল্পক্ষণের মধ্যেই টনক নড়ে ওঠে শত্রুপক্ষের।
চোখে সর্ষেফুল দেখতে শুরু করে তারা।
শেষমেষ মুসলিমবাহিনীর সঙ্গে পেরে উঠতে না পেরে শোচনীয়ভাবে পরাজয়বরণ করে।
মুসলিমবাহিনী ছিল সেলজুক সালতানাতের আর খ্রিষ্টানবাহিনী ছিল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের। নিশ্চিত পরাজয়ের মুখ থেকে বাঁচানোর কারণে এরতুগরুল ও তাঁর বাহিনীকে একমাত্র আল্লাহর বিশেষ সাহায্য হিসেবে ধরে নেন মুসলিমবাহিনীর সিপাহসালার সেলজুক সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদ।
তিনি এরতুগরুল ও তার যোদ্ধাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান।
আর কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ এরতুগরুলকে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সীমান্তঘেঁষা পশ্চিম আনাতোলিয়ার কিছু ভূমির জায়গিরদারি দান করেন।
কালের আবর্তে এই জায়গিরটিই বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের জন্য হুমকি হয়ে ওঠে।
এরতুগরুল দিনে দিনে বাইজেন্টাইন ভূমি জয় করে তাঁর জায়গিরের সীমানা বর্ধিত করতে থাকেন।
বাইজেন্টাইন রোমানদের প্রতিরোধের জন্য এরতুগরুলের জায়গির হয়ে যায় সেলজুক সালতানাতের ডানহাত, এক বিশ্বস্ত বন্ধু, সর্বোপরি সেলজুক সালতানাতের ভূমি আনাতোলিয়ার পশ্চিমের সীমান্ত রক্ষার এক অতন্দ্র প্রহরী।
জীবনভর সেলজুক সালতানাতের অনুগত ছিলেন এরতুগরুল,তাঁদের নির্ভরযোগ্য মিত্র।
১২৮৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করলে তাঁর উত্তরাধিকার হন তাঁরই সুযোগ্য সন্তান উসমান বিন এরতুগরুল।
নিজের হাতে তুলে নেন পশ্চিম আনাতোলিয়ার জায়গিরদারি।
তাতারদের হাতে সেলজুক সালতানাতের পতন হলে তিনি ১২৯৯ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনভাবে প্রতিষ্ঠা করেন 'সালতানাতে উসমানিয়াহ' বা উসমানি সাম্রাজ্য।
১২৯৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৩২৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি উসমানি সালতানাত পরিচালনা করেন।
১২৯৯ খ্রিষ্টাব্দের আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন পিতার মতোই সেলজুক সালতানাতের একান্ত অনুগত একজন জায়গিরদার।
পশ্চিম আনাতোলিয়ার এই ছোট্ট জায়গিরটিই পরবর্তী সময়ে ইতিহাসে 'উসমানি খিলাফত' নাম ধারণ করে।
শুধু পশ্চিম আনাতোলিয়া নয়; পুরো আনাতোলিয়া, এশিয়া মাইনর, পূর্বপ্রাচ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা ও উত্তরপূর্ব ইউরোপের ৩৪টি প্রদেশ নিয়ে প্রায় ৫২ লাখ বর্গকিলোমিটার জুড়ে ছিল এই খিলাফতের সীমানা, যে সীমানায় আজকের পৃথিবীর মানচিত্রে প্রায় ৪২টি দেশের অবস্থান।
যে খিলাফত ছিল ইসলামের তিনটি বড় খিলাফতের অন্যতম। ছিল ইসলামি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মুসলিম সামরিক শক্তিধর, দুর্দান্ত ও মহাপ্রতাপশালী মুসলিম সাম্রাজ্য।
যে সাম্রাজ্যের ভয়ে থরথর করে কাপত তখনকার অপরাপর পরাশক্তিগুলো।
এমনকি আমেরিকা-রাশিয়া পর্যন্ত যে সাম্রাজ্যের কাছে নতশিরে কর প্রদান করত! কাল থেকে কালান্তরে বহু ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতন ও চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এই খিলাফত টিকেছিল বিংশ শতাব্দীর শুরুলগ্ন পর্যন্ত।
আফসোসের বিষয় হচ্ছে, ঘরের বাইরের শত্রুদের ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে শেষের দিকে খিলাফত দুর্বল হয়ে পড়ে।
মুসলমানদের স্থায়ী দুশমন, পশ্চিমা কাফিরদের এজেন্ট, ইয়াহুদি বংশোদ্ভূত মুসতাফা কামাল পাশার হাতে ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩ মার্চ বিলুপ্ত হয়ে যায়।
ফলে ৬ শতাধিক বছর ধরে বিশ্বের আকাশে ঔজ্জ্বল্য ছড়ানো এই আলোক-রশ্মি নিভে যায় চিরতরে! পৃথিবী বঞ্চিত হয় ঐশীবিধানে পরিচালিত একটি সুন্দর ও বরকতময় শাসনব্যবস্থা থেকে, ইনসাফ ও মানবতার মূর্তপ্রতীক কিছু শাসক ও তাঁদের শাসন থেকে।
উসমানি খেলাফতের স্বর্ণ কণিকা
Thanks everyday