![]() |
সুলতানের ছদ্মবেশী সফর: একটি ঐতিহাসিক ও মানবিক গল্প |
১. বাগদাদের গভীর রাত
বাগদাদের রাত তখন গভীর, চাঁদ নিজ আলো ছড়িয়ে দিয়েছে শহরের ছাদগুলোর ওপর। পুরো নগরী ঘুমে আচ্ছন্ন, কিন্তু খলিফা হারুন অর রশিদ প্রাসাদের বাগানে একা বসে ছিলেন, একপ্রকার শূন্য মনে। তাঁর চোখে ঘুমের ছায়া ছিল না, মনে যে চিন্তার স্রোত বয়ে চলছিল। একের পর এক বিচারকের নালিশ আসছিল, যেখানে বলা হচ্ছিল বাগদাদের সাধারণ মানুষ কিছু অসৎ বণিকদের দ্বারা প্রতারিত হচ্ছে। অনেকেই তাদের জমি হারাচ্ছে, আর কিছু কৃষকের উপার্জনও রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই অনাচার তাঁর শাসন ব্যবস্থায় এক অশান্তির চিত্র তুলে ধরে।
তাঁর কাছে যখন প্রতিটি রিপোর্ট পৌঁছাচ্ছিল, তখন মনে প্রশ্ন আসছিল— "আসল সত্যটা কোথায়?" বিচারকদের দেওয়া রিপোর্টগুলো কি পুরোপুরি সঠিক? নাকি, কিছু সত্য গোপন রাখা হচ্ছে? তিনি জানতেন, আদালতের রায় ও প্রাসাদের রিপোর্টের ওপর নির্ভর করলেই মানুষের সমস্যার সমাধান পাওয়া সম্ভব নয়। তাই সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি নিজেই নগরের সাধারণ মানুষদের মধ্যে গিয়ে তাঁদের জীবনযাত্রা পর্যবেক্ষণ করবেন। আর সে জন্য তিনি রাতের বেলা ছদ্মবেশ ধারণ করবেন।
২. প্রস্তুতি ও যাত্রা
খলিফার বিশ্বস্ত উপদেষ্টা জাফর বরমকি এবং তাঁর শক্তিশালী দেহরক্ষী মাসরুর-কে ডেকে বললেন,
— "আজ রাতে আমাদের রাজপ্রাসাদ ছেড়ে সাধারণ মানুষের মতো চলতে হবে। আমি যদি সিংহাসনে বসে থাকি, তবে কখনোই বুঝতে পারব না মানুষের সত্যিকারের অনুভূতি।"
এভাবে প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পর, তাঁরা তিনজন একে অপরকে সাধারণ মানুষের পোশাকে সজ্জিত করে, রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে পড়লেন। রাতের অন্ধকারে, নিভিনিভি প্রদীপের আলোর মতো নগরী কিছুটা জেগে ছিল। কিছু মানুষ ব্যবসা-সম্পর্কিত কাজ করছে, কেউ কেউ আগুনের চারপাশে বসে আড্ডা মারছে, আবার কিছু শিশু খেলা করছে।
৩. সুগন্ধি বাজারের কান্না
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে তারা সুগন্ধি বাজার নামক অঞ্চলে পৌঁছালেন। বাজার তখনও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। দোকানগুলোতে কিছু ব্যবসায়ী মিষ্টি ও সুগন্ধি মালামাল গুছিয়ে রাখছিল, আর কিছু ক্রেতা পণ্য কিনতে আসছিল। তারা লক্ষ্য করলেন বাজারের কর্নারে এক দরিদ্র কৃষক মাটিতে বসে কান্না করছে। তাঁর চোখে হতাশার কালো মেঘ। তার মুখে সেই দুঃখ-কষ্ট, যেন সে তার জীবনের সবকিছু হারিয়ে ফেলেছে। এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক ধনী বণিক, যার মুখে ছিল একটু তাচ্ছিল্যের হাসি। খলিফা এগিয়ে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন,
— "এ কৃষক কেন কাঁদছে?"
বণিক তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
— "এ আমার কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিল। সময়মতো ঋণ পরিশোধ না করায়, আমি তার জমি নিয়ে নিয়েছি।"
কৃষক দুর্বল কণ্ঠে বলল,
— "আমার ফসল এক মাস দেরিতে পাকা হয়েছে। আমি শুধু আরও এক মাস সময় চেয়েছিলাম। কিন্তু সে আমাকে কোনও সুযোগ দেয়নি।"
এটা শোনার পর খলিফার চোখে তীক্ষ্ণ এক দৃষ্টি চলে এল। কিছু সময় স্থির দাঁড়িয়ে থাকার পর তিনি বণিককে প্রশ্ন করলেন,
— "তুমি কি তাকে আর একটু সময় দিতে পারতে না?"
বণিক ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে বলল, "ব্যবসায়ী হিসেবে আমি দয়া করতে বসিনি। আমি শুধু ব্যবসা করি, নিয়ম অনুযায়ী চলি।"
এ কথা শোনার পর খলিফা বুঝলেন, এই বণিক একদম নিষ্ঠুর, একপেশে ও অন্যায়ভাবে কাজ করছে। কিন্তু তিনি তখনও নিজের পরিচয় প্রকাশ করলেন না।
৪. রাতের অন্ধকারে বিচার
সকালের প্রথম প্রহরে, খলিফা রাজ দরবারে এলেন। দরবারে উপস্থিত সবাই একে অপরের দিকে তাকিয়ে ছিল, অবাক হয়ে যাচ্ছিল— এই যে মহান সুলতান হারুন অর রশিদ, যিনি পুরো বাগদাদের শাসন করছেন, তিনি কি এই ব্যক্তিই? তাদের কল্পনার বাইরে, দরবারের মধ্যে গিয়ে সুলতান ঘোষণা করলেন,
— "আজ আমি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিচার করার জন্য এসেছি। আজকের বিচার হলো এক ব্যবসায়ী ও এক কৃষকের মধ্যে।"
আরবি ভাষায় পড়ুন...........
![]() |
رحلة الخليفة المتخفي: قصة تاريخية وإنسانية |
এ সময়, সেই বণিক দরবারে উপস্থিত হতে এল। সে যখন দেখল, গত রাতে যে ব্যক্তি তার সাথে কথা বলেছিল, সে আসলে হারুন অর রশিদ, তখন তার মুখ একেবারে সাদা হয়ে গেল। ভয় ও আতঙ্কে তার শরীর কাঁপছিল।
খলিফা ঘোষণা করলেন,
— "তুমি এক দরিদ্র কৃষকের সবকিছু কেড়ে নিয়েছ, অথচ তুমি ধনী। তুমি তাকে সময় দিতে পারতে, কিন্তু তা করোনি। তুমি কেবলমাত্র নিজের লাভের কথা চিন্তা করেছ।"
তারপর সুলতান বললেন,
— "তুমি তার জমি ফেরত দেবে, এবং তাকে ঋণ পরিশোধের জন্য আরও এক মাস সময় দেবে।"
দরবারে উপস্থিত জনগণ উল্লাসিত হয়ে উঠল, তারা খলিফার ন্যায়বিচারের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করল। সে দিন থেকেই বাগদাদের ব্যবসায়ীরা শিখে গিয়েছিল, খলিফা শুধুমাত্র সিংহাসনে বসে রাজত্ব করেন না, বরং তিনি রাতের অন্ধকারে নগরী পরিদর্শন করেন এবং সাধারণ মানুষের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেন।
৫. এক মহান শাসকের শিক্ষা
এটি ছিল শুধু একটি কাহিনি নয়, বরং একটি শিক্ষা, যা শাসক, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে সম্পর্কের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করে। সুলতান হারুন অর রশিদ শুধু একজন প্রশাসক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন ন্যায়বিচারক, যিনি জানতেন কিভাবে তাঁর জনগণের দুঃখ-কষ্ট বুঝে তাদের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়।
তাঁর এই ছদ্মবেশী সফর প্রমাণ করল, একজন শাসক যদি সিংহাসনে বসে শুধু রাজনীতি করেন, তবে কখনওই তিনি জনগণের সঠিক অবস্থা জানতে পারবেন না। তাঁর এই মানবিক সিদ্ধান্ত ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে, কারণ সত্যিকারের শাসক সেই, যিনি শুধু ক্ষমতার মসনদে বসে থাকেন না, বরং তাঁর জনগণের হৃদয় জয় করতে জানেন।
Thanks everyday