ইউরোপ সীমান্তে ৮০ জন মুজাহিদ , ওসমানী খেলাফতের স্বর্ণ কণিকা। Ofde islam

1

 



ইউরোপ সীমান্তে ৮০ জন মুজাহিদ 


উরখান বিন উসমান (১৩২৬-১৩৬০)। উসমানি সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা উসমান বিন এরতুগরুলের সুযোগ্য সন্তান। 

পিতার মৃত্যুর পর উসমানি সালতানাতের মসনদে সমাসীন হন।

 পিতার মতোই ন্যায়পরায়ণ আর বিচক্ষণতার সঙ্গে তিনি সালতানাত পরিচালনা করতে শুরু করেন। 

একদিন সালতানাতের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে পরামর্শ করতে মন্ত্রীবর্গ ও 'কারি' গোত্রের বিশিষ্ট লোকজনকে তাঁর দরবারে ডেকে পাঠান।


সুলতানের ফরমান পেয়ে সবাই যথাসময়ে এসে হাজির। 

বিশাল দরবারে সুলতানের জন্য সবাই চুপচাপ বসে অপেক্ষা করছেন। 

ভেতরে ভেতরে সবাই বেশ কৌতূহলী, নিজেদের মনকে প্রশ্ন করে চলেছেন – বিষয়টা কী? 

কেন সুলতান তাঁদের ডেকে পাঠালেন?

 বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সঙ্গে নতুন কোনো চুক্তি হবে, যাতে তাদের পরামর্শ নেওয়াটা জরুরি? 

কিন্তু কেউ কিছুই জানেন না। 

এ নীরবতা বেশিক্ষণ থাকেনি। হঠাৎ দরবারে প্রবেশ করেন সুলতান উরখান।


পিছু পিছু তাঁর বড় ছেলে সুলায়মান পাশা। 

দরবারে ঢুকেই তিনি সবাইকে সালাম দেন- 

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ !

উপস্থিত সবাই তার সালামের জবাব দেন। 

তাদের দৃষ্টি সুলতানের দিকে। 

সবাই তাঁর ফরমানের অপেক্ষার।


সুলতান উরখান উপবিষ্টদের মধ্যে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেন একবার।

 এরপর বলেন,

 “আমার ভাই ও বন্ধুগণ !

আপনারা জানেন, আমরা বুরসা শহরের কর্তৃত্ব লাভ করতে পেরেছি। 

বুরসাকে আমাদের সাম্রাজ্যের রাজধানী বানিয়েছি, 

এর দ্বারা আল্লাহর তাওফিকে আমরা আমাদের মরহুম পিতা সুলতান উসমান বিন এরতুগরুলের অসিয়ত পূর্ণ করতে পেরেছি।

 এ অঞ্চলের সব বাইেজেন্টাইন দুর্গ ও শহর বিজয় করে নিয়েছি। 

এমনকি তাদের সম্রাট ‘ষষ্ঠ ইয়েনিজ ক্যান্টকুজিন্যাস' আমাদের সঙ্গে চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছেন। 

কিন্তু আমার ভাইয়েরা,

 এটাই আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়, 

রুমেলি পর্যন্ত আমাদের পৌঁছতে হবে, সেখান থেকে আবারও বিজয়ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। 

সুতরাং আপনাদের মতামত কী?'

গাজি ফাজিল বেগ উঠে দাঁড়ান। 

তিনি 'কায়ি' গোত্রের একজন সেনা কমান্ডার। 

তিনি এমনভাবে চিৎকার করে বলতে শুরু করেন, 

যা উপস্থিত সবার মধ্যে অত্যন্ত প্রভাব বিস্তার করে।

তিনি বলেন, 'আল্লাহু আকবার! আল্লাহু আকবার! 

الله أكبر ،الله أكبر

আমরা তো অনেক দিন থেকেই এরকম একটি সুসংবাদের অপেক্ষা করছিলাম! 

আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন!

আপনি আগে চলুন, আমরা আপনার সঙ্গে আছি।

তাঁর কথা উপস্থিত সবার মধে এক নবপ্রাণের সঞ্চার করে। 

খুশি আর আবেগের

আতিশয্যে একে অপরকে অভিবাদন আর কোলাকুলি করতে থাকেন।

এ সময় শাহজাদা সুলায়মান পাশা একটু ঝুঁকে পিতার কানে মৃদুস্বরে বলেন,

আব্বাজান, এ জিহাদের নেতৃত্ব কি আপনি আমাকে দেবেন না?

টগবগে নওজোয়ান পুত্রের আগ্রহ আর সাহস দেখে পিতার অন্তর খুশিতে ভরে ওঠে। 

সে খুশির আমেজ তাঁর ঠোঁটে ঈষৎ মুচকি হাসির রেখা হয়ে মিলিয়ে যায়। 

কিন্তু তিনি কিছুটা ইতস্ততবোধ করলেন। 

এ হামলা সাধারণ কোনো হামলা ছিল না, হামলাটি একজন অভিজ্ঞ ও প্রজ্ঞাপূর্ণ কমান্ডারের মুখাপেক্ষী ছিল। 

এ জন্য তিনি অপরাপর কমান্ডারদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন।

—আমার পুত্র সুলায়মান এই হামলার নেতৃত্ব দিতে চায়! আপনারা কী বলেন? 

কমান্ডাররা শাহজাদা সুলায়মানকে খুব ভালোভাবে চিনতেন।

 যেসব যুদ্ধে সুলায়মান তাঁদের সঙ্গে ছিলেন, সেসব যুদ্ধে সুলায়মানের সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদান তাঁরা খুব ভালোভাবে প্রত্যক্ষ করেছিলেন, 

এ জন্য তাঁরা জবাব দেন, —ভালো। 

তাহলে তিনিই নেতৃত্ব দেবেন। 

আমরা তাঁর অধীনে থাকব, তাঁর নির্দেশে ঝাঁপিয়ে পড়ব।


—তাহলে আল্লাহর ওপর ভরসা করে এই হামলার নেতৃত্ব তাঁর ওপরই ছেড়ে দিচ্ছি। 

তবে আমার ভাইয়েরা, 

আমি আশা রাখব, 

আপনারা তাকে সর্বাত্মক সাহায্য করবেন। 

সে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরামর্শ চাইলে সুপরামর্শ দেবেন। 

বৈঠক শেষ হয়ে যায় এখানেই।

একদিন ভোরে মুসলিম সেনাবাহিনীতে ব্যাপক রণপ্রস্তুতি দেখা যায়। 

তরবারি ও বর্ষাগুলো ধার দেওয়া হয়, বর্ম পরা হয়।

ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি পরিবেশকে মুখর করে তোলে। 

খানিক পরেই খটাখট খটাখট আওয়াজ তুলে ঘোড়া ছুটিয়ে মুজাহিদরা দক্ষিণ দিকে যাত্রা করেন।

 বনবাদাড়, রাস্তাঘাট তেপান্তর পাড়ি দিয়ে তারা সমুদ্রতীরে এসে উপনীত হন। 

এখন সামনে দিগন্তবিস্তৃত অথৈ জলরাশি। 

সমুদ্রের ওপারে ইউরোপ মহাদেশ। 

সাগর পাড়ি দিতে পারলেই ইউরোপের মাটি।

 সাগরপাড়ে মুসলিমবাহিনী ছাউনি ফেলে, খুঁজতে শুরু করে সাগর পাড়ি দেওয়ার পথ। 

কীভাবে সাগর পাড়ি দেওয়া যায়, সেনাপ্রধান সুলায়মান পাশা সেই চিন্তায় বিভোর।

 সাগরপাড়ে মৃদুমন্দ বাতাসের পরশে আনমনে বসে এ ব্যাপারে চিন্তা করে চলছেন শাহজাদা সুলায়মান।

সাগরের অপর তীর খুঁজে ফিরছে তাঁর দৃষ্টি। 

ধীরপায়ে তার পাশে এসে দাঁড়ান গাজি ফাজিল বেগ। 

সঙ্গে যোদ্ধা 'আজাহ বাই'।  শাহজাদাকে উদ্দেশ করে গাজি ফাজিল বেগ বলেন,

-কী ভাবছেন মহামান্য শাহজাদা?

—চিন্তা করছি কীভাবে এ সমুদ্র পাড়ি দেওয়া যায়। 

ওপারে যাওয়া যায়! 

তা-ও গোপনে, যাতে শত্রুপক্ষের কেউ টের না পায়। 

-যদি আপনি অনুমতি দেন, তাহলে আমরা অচিরেই এই সাগর পাড়ি দিতে পারি।

— সেটা কীভাবে?

-আমরা জানতে পেরেছি অদূরে একটি সংকীর্ণ রাস্তা আছে, 

যে রাস্তা দিয়ে গেলে সহজে সাগর পাড়ি দেওয়া যাবে এবং সেখানে ইউরোপীয়দের একটি দুর্গ আছে। 

—ভালো, তাহলে তা-ই করা যাক।।


তারপর তাঁরা কয়েকজন মিলে সেই সংকীর্ণ রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছে যান। 

গাছ কেটে তারা একটি ছোট নৌকাও বানিয়ে নেন। 

রাতের আঁধার নামতেই কয়েকজন যোদ্ধা নিয়ে গাজি ফাজিল বেগ এবং যোদ্ধা আজাহ বাই নৌকায় চড়ে বসেন। 

কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁরা অন্য তীরে পৌঁছে যান। 

সেখানে তাঁরা ঘুমন্ত একজন মানুষ দেখতে পান। 

সুযোগ বুঝে তাঁরা লোকটিকে পাকড়াও করে সেনাপ্রধান শাহজাদা সুলায়মানের কাছে নিয়ে আসেন।

ভয়ে লোকটি তখন কাঁপছিল। 

সে মনে করছিল তাঁরা তাকে হত্যা করে ফেলবে। 

কিন্তু শাহজাদা সুলায়মান তাকে অভয় দেন, সান্ত্বনাবাণী শোনান। নতুন একজোড়া কাপড় পরতে দেন, আরও অনেক কিছু উপহার দেন। 

উপহার পেয়ে লোকটি অবাক হয়।


এবার শাহজাদা সুলায়মান লোকটির কাছে জানতে চান,


—তুমি কি আমাদের এমন কোনো পথ দেখিয়ে দিতে পারবে, 

যে পথ দিয়ে আমরা গোপনে ওই দুর্গে প্রবেশ করতে পারব?


-হ্যাঁ শাহজাদা! 

আমি পারব। 

আমি দুর্গটাকে খুব ভালোভাবে চিনি। 

–সত্যিই যদি তুমি তা পারো, তবে তোমাকে অনেক বড় পুরস্কার দেওয়া হবে।

-আমি আপনাকে ওয়াদা দিচ্ছি শাহজাদা! 

কেউ টের পাবে না। 

শাহজাদা সুলায়মান তাড়াতাড়ি আরও বড় আকৃতির কিছু নৌকা তৈরির ফরমান জারি করেন। 

পরদিন বিকেলে তিনি ৮০ জন যোদ্ধা নির্বাচন করেন। 

এদের নিয়েই তিনি আরোহণ করেন সদ্য তৈরি নৌকাগুলোতে।

 রাতের ঘনকালো অন্ধকারে খুব তাড়াতাড়ি সাগরের ওই পাড়ে পৌঁছে যান, কেউ টেরও পায়নি। 

দুর্গে প্রবেশের জন্য গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি একটি গোপন সুড়ঙ্গপথ দেখিয়ে দেয়।


(উল্লেখ্য, ইতিহাসবিদদের মতে, ওই সুড়ঙ্গপথটি ছিল দুর্গের ভেতর থেকে সাগরে ময়লা পানি নিষ্কাশন করার নালা।)


সেনাপ্রধান শাহজাদা সুলায়মান নির্বাচিত ৮০ জন সৈন্য নিয়ে ক্ষিপ্রগতিতে দুর্গের ভেতর ঢুকে পড়েন।

 তখন ছিল ফসল কাটার মৌসুম। দুর্গের বেশিরভাগ লোকই দুর্গের বাইরে বাগান ও শয্যখেতে ফসল কাটতে ব্যস্ত ছিল। 

তাই দুর্গ বিজয় করতে কোনো বেগ পেতে হয়নি। 

কোনো ধরনের রক্তপাতেরও প্রয়োজন পড়েনি। 

দুর্গের ভেতর যারা ছিল, তারা সহজেই আত্মসমর্পণ করে। মুসলমানদের সাদরে বরণ করে নেয়। 

যেহেতু মুসলমানরা তাদের কোনো কষ্ট দেয়নি।

শাহজাদা সুলায়মান তখনই কিছু লোককে পাঠিয়ে সাগরপাড়ে দুর্গের নোঙর করা নৌকাগুলো দখল করে ওপারে রেখে আসা বাকি সৈন্যদের নিয়ে আসতে আদেশ দেন।


 কিছুক্ষণ পর সাগর পাড়ি দিয়ে এসে বাকি সৈন্যরাও দুর্গে আসতে শুরু করে। 

এরপর শাহজাদা সুলায়মান কর্তৃক দুর্গ জয়ের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার আগেই পার্শ্ববর্তী আরেকটি বড় দুর্গে অকস্মাৎ আক্রমণ করে বসেন। 

দুর্গবাসী কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুর্গ পদানত হয়ে যায়। 

দুর্গবাসী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। 

এভাবেই দু-দুটি বড় দুর্গ জয় করে নেওয়ার দ্বারা মুসলমানরা প্রথম ইউরোপের মাটিতে পা রেখেছিলেন। 

এখান থেকেই পতপত করে ইউরোপের আকাশে উড়েছিল মুসলমানদের বিজয় কেতন।


ইতিহাসবিদদের মতে, বিজিত এই অঞ্চল ছিল ইউরোপের বর্তমান বলকান অঞ্চল।



Post a Comment

1Comments

Thanks everyday

  1. আমাদের কনটেন্ট গুলো ভালো লাগলে অবশ্যই শেয়ার করে অন্যকে জানার সুযোগ করে দিবে

    ReplyDelete
Post a Comment
To Top