তাঁর নাম হামিদ আসর অলি, কিন্তু বুরসা শহরের লোকেরা তাঁকে সমুনজুবাবা নামে চিনত।
তুর্কিভাষায় সমুনজ অর্থ রুটি।
তিনি বুরসার অলিগলিতে ঘুরে ঘুরে রুটি বিক্রি করতেন।
তিনি কায়সেরি শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
শাম, তাবরিজ ও ইরানের আরদাবেল শহরে সফর করে ইলম অর্জন করেন।
আরদাবেলের প্রসিদ্ধ আল্লাহওয়ালা আলাউদ্দিন আরদাবেলির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন, দীর্ঘসময় তাঁর খিদমতে থাকেন, এভাবে একদিন আধ্যাত্মিকতায় পূর্ণতা লাভ করেন, নিজের শায়খের মতো তিনিও একজন আল্লাহর খাস অলি হয়ে যান।
এরপর তিনি বুরসা শহরে ফিরে আসেন, এখানেই বসবাস করতেন,
তখনকার সময়ে বুরসা উসমানি সালতানাতের রাজধানী ছিল,
সুলতান প্রথম বায়েজিদের শাসনকাল চলছিল।
বুরসা শহরে বেশ কয়েক বছর তিনি তার জীর্ণশীর্ণ কুটিরে দিনাতিপাত করেন,
এ কুটিরেই তিনি রুটি বানিয়ে বড় একটি ঝুলিতে নিয়ে বিক্রির জন্য বুরসার অলিগলিতে ঘুরতেন। শিশুরা তাঁকে দেখামাত্রই চিৎকার করে বলে উঠত—
"সমুনজুবাবা এসে গেছেন... সমুনজুবাবা এসে গেছেন...!'
দেখতে না দেখতেই তাঁর আশেপাশে রুটি খরিদ করতে শিশুরা জটলা পাকিয়ে ফেলত।
বুরসার সব শিশুকিশোর ও অধিবাসীরাও তাঁকে ভালোবাসত, তাঁর চেহারা ছিল উজ্জ্বল, এক অলৌকিক জ্যোতিতে জ্যোতির্ময়।
তিনি শিশুকিশোরদের খুবই ভালোবাসতেন, তাদের সঙ্গে খুনসুটিতে মেতে উঠতেন, আদর করতেন, স্নেহ করতেন, পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন, সবচেয়ে বড়কথা, তাঁর রুটিও ছিল নরম ও সুস্বাদু।
যখন সুলতান প্রথম বায়েজিদ উলু জামে মসজিদ নির্মাণ শুরু করেন,
![]() |
উলু জামে মসজিদের অযুর হাউস |
দেখতে দেখতে একসময় উলু জামে মসজিদের নির্মাণকাজ শেষ হয়ে গেল।
প্রশস্ত আঙিনার মসজিদটি কানায় কানায় ভরে যায়। সুলতান ডানে-বামে তাকিয়ে বুরসার প্রসিদ্ধ আলিম আমির সুলতানকে দেখতে পান।
তাঁকেই খুতবা দিয়ে সালাত পড়ানোর জন্য অনুরোধ দেন।
আমির সুলতান মিম্বারের কাছে এসে দাঁড়ান। জনাকীর্ণ মসজিদে তিনি অনুসন্ধানীদৃষ্টিতে এদিক-সেদিক তাকাতে থাকেন। দেখে মনে হচ্ছিল, তাঁর চোখজোড়া কাউকে খুঁজছিল,
হ্যাঁ, তাঁর চোখ সত্যিই একজনকে খুঁজছিল,
যাঁকে খুঁজছিল, তিনি হলেন সমুনজুবাবা।
তিনি সমুনজুবাবার ইলম ও মর্যাদা সম্পর্কে ভালোভাবে জানতেন, যদিও তা ছিল গোপন, একেবারে কেউ তা জানত না। তারা তাঁকে একজন রুটিওয়ালা ছাড়া আর কিছুই মনে করত না। একসময় তাঁর দৃষ্টি সমুনজুবাবার ওপর গিয়ে পড়ে। সমুনজুবাবার ওপর তাঁর দৃষ্টি পড়তেই তিনি তাঁর দিকে ইশারা করে বলেন, 'এ মসজিদে খুতবা প্রদানের জন্য এই ব্যক্তির চেয়ে যোগ্য আর কেউ নেই বলেই আমার মনে হচ্ছে!”
উপস্থিত মুসল্লিরা অবাক হন! তারা আমির সুলতান যে দিকে ইশারা করেছেন, সে দিকেই তাকাতে শুরু করে। অবস্থা আঁচ করতে পেরে সমুনজুবাবা অস্বস্তিবোধ করতে থাকেন। কারণ, দীর্ঘ কয়েক বছর তিনি তাঁর প্রকৃত পরিচয় লুকিয়ে রাখতে পারলেও আজ আর পারেননি,আমির সুলতান তাঁর আসল পরিচয় প্রকাশ করে দেন! এত দিন লোকেরা তাঁকে শুধুই একজন সাধারণ রুটিওয়ালা মনে করত; কিন্তু আজ সব গোপনীয়তা উন্মোচিত হয়ে গেল!আমির সুলতানের অনুরোধে আর সুলতান বায়েজিদের একরকম আদেশে বাধ্য হয়ে তিনি উঠে দাঁড়ান। মিম্বারের দিকে এগিয়ে যান, জনাকীর্ণ বিশাল মসজিদের চোখগুলো তাঁর দিকে এক অবাক-বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে! মিম্বারে আরোহণের আগে তিনি একটু ঝুঁকে আমির সুলতানের কানে কানে একটু অনুযোগের সুরে বলেন,
'এ কী করলেন ভাই!
সবার সম্মুখে আমার গোপনীয়তা উন্মোচিত করে দিলেন?আমির সুলতানও উত্তরে তাঁর কানে কানে বলেন, 'এ মসজিদে খুতবা দিতে আপনিই যে একমাত্র উপযুক্ত, ভাই আমার। এতদিনের ছদ্মবেশী বুজুর্গ অবশেষে মিম্বারে আরোহণ করেন। আল্লাহর প্রশংসা ও রাসুলের ওপর সালাতের পর তিনি প্রথমে সুরা ফাতিহা তিলাওয়াত করেন, এরপর সুরা ফাতিহার সাত-সাতটি তাফসির পেশ করেন, যা উপস্থিত মুসল্লিদের মধ্যে অত্যন্ত প্রভাব ফেলে। এই জুমআয় তখনকার প্রসিদ্ধ আলিম মোল্লা ফানারিও উপস্থিত ছিলেন, তিনি এই খুতবা শুনে বিস্ময়াভিভূত হন। জুমআর সালাত শেষে তিনি তাঁর সঙ্গীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আমরা এই ব্যক্তিকে দেখেছি, তাঁর খুতবা শুনেছি, আর তাঁর ইলম ও ইলমে তাফসিরের গভীর পাণ্ডিত্য অনুধাবন করেছি।
তিনি সুরা ফাতিহার যে সাতটি তাফসির পেশ করেছেন, এর মধ্যে প্রথম তাফসির উপস্থিত সবাই বুঝেছে। দ্বিতীয় তাফসির প্রায় অর্ধেকের মতো লোক বুঝতে পেরেছে।
তৃতীয় তাফসির খুব কমসংখ্যক লোক বুঝতে পেরেছে।
আর চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম তাফসির আমাদের বোঝার সাধ্য ছিল না!'
বিদ্যুৎগতিতে এ ঘটনা পুরো বুরসায় ছড়িয়ে পড়ে! লোকেরা রুটিওয়ালার ছদ্মবেশে থাকা এই বুযুর্গের প্রকৃত পরিচয় জানতে পারে।
সবাই জানতে পারে, এতদিন রুটির বিরাট ঝুলি পিঠে উঠিয়ে, মাথায় বয়ে বুরসার অলিগলিতে ঘুরে ঘুরে যিনি রুটি বিক্রি করতেন, শিশুকিশোরদের সঙ্গে খুনসুটি করতেন, তাদের স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসায় জড়িয়ে নিতেন; তিনি সাধারণ কোনো মানুষ ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন বড় আলিম।
একজন খাঁটি আল্লাহর অলি। তারা তাঁকে একনজর দেখে হাতে চুমু খেতে এবং দুআ নিতে জড়ো হতে থাকে, কিন্তু তাদের সে আশা আর পূরণ হয়নি,
তারা আর তাকে দেখতে পায়নি।
কখনো দেখতে পায়নি,
হ্যাঁ, সত্যিই দেখতে পায়নি, কারণ, খুতবার পরপরই অন্য কোনো শহরে চলে গিয়েছিলেন,
এমন শহরে, যেখানে কেউ তাকে চেনে না, কেউ তাঁর সম্পর্কে জানে না, কিছুই জানে না।
পাঠক, আপনি কৌতূহল বোধ করছেন নিশ্চয়? এতক্ষণ আমরা কার ঘটনা বলেছি, কার মাহাত্ম্যের কথা শুনিয়েছি.... এতক্ষণ আমরা আল্লাহর অলি হামিদ আকসর অলির কথা বলেছি, শুনিয়েছি তাঁর ইখলাস ও প্রচারবিমুখতার ঘটনা, সমুনজুবাবা নামে পরিচিত আল্লাহর এ প্রিয় বান্দা মৃত্যুবরণ করেছিলেন আকসারায়ে শহরে,
সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়।
সিরিজ- উসমানি খেলাফতের স্বর্ণ কণিকা।
Thanks everyday