কালিমা পড়াতে গিয়ে সুলতানের শাহাদতবরণ, (উসমানী খেলাফতের স্বর্ণ কণিকা) ofde islam.

0


 কালিমা পড়াতে গিয়ে সুলতানের শাহাদতবরণ।


সুলতান প্রথম মুরাদ (১৩২৬-১৩৮৮)। সুলতান উরখান গাজির সুযোগ্য সন্তান।
 পিতার মৃত্যুর পর তিনিই উসমানি সালতানাতের মসনদে সমাসীন হন। 
তিনি ছিলেন জিহাদের ময়দান দাপিয়ে বেড়ানো একজন বীর যোদ্ধা। 
সুদীর্ঘ শাসনকালের অন্তত ৩০ বছর কেবল বিজয় অভিযানেই অতিবাহিত করেছেন। 
তিনি যখন উসমানি সালতানাতের মসনদে সমাসীন হন, তখন উসমানি সালতানাতের আয়তন ছিল ১ লাখ কিলোমিটার।
 কিন্তু তাঁর ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে তা চারগুণ পর্যন্ত বর্ধিত হয়। 
তাঁর বেশিরভাগ অভিযান ছিল ইউরোপে। সুলতান প্রথম মুরাদের ধারাবাহিক বিজয়ে ইউরোপীয় ক্রুসেডারদের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছিল।
ইউরোপভূমিতে সুলতান প্রথম মুরাদের বিজয় অভিযান ঠেকাতে এবং ইউরোপের ভূখণ্ড থেকে মুসলমানদের তাড়াতে বুলগেরিয়া, সার্বিয়া, পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরির মতো ইউরোপীয় দেশগুলো চুক্তিবদ্ধ হয়—তারা হাঙ্গেরির সম্রাট লুইসের নেতৃত্বে সুলতান প্রথম মুরাদের মোকাবিলায় ব্যাপক রণপ্রস্তুতি নিয়ে উসমানি সালতানাতের সীমানার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে।
সুলতান প্রথম মুরাদ তাঁর অধিকাংশ সৈন্য নিয়ে তখন রাজধানী বুরসাতে অবস্থান করছিলেন। সুলতানের একজন কমান্ডার ‘হাজি ইলবি' ১০ হাজার সৈন্য নিয়ে সীমান্তেই অবস্থান করছিলেন। তিনি যখন এ সংবাদ পেলেন যে, ইউরোপবাসী হাঙ্গেরির সম্রাটের নেতৃত্বে বিশাল সেনাবহর নিয়ে উসমানি সেনাবাহিনীর ওপর হামলা করতে সীমান্তের কাছাকাছি চলে এসেছে, তখন তিনি তাঁর ১০ হাজার সৈন্যের বাহিনী নিয়েই তাদের মোকাবিলা করতে রওনা হয়ে যান। পথিমধ্যে উভয় বাহিনী মুখোমুখি হয়ে যায়।
ইউরোপের সম্মিলিত বাহিনী উসমানি বাহিনীর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ছিল। তারা জানতে পেরেছিল, কাছেই কোথাও স্বল্পসংখ্যক সৈন্যের উসমানি বাহিনী তাঁবু ফেলেছে। তাই তারা উসমানিদের পক্ষ থেকে আক্রমণাত্মক হামলা না হওয়ার ব্যাপারে একেবারে নিশ্চিন্ত ছিল। 
তাদের ধারণাই ছিল না যে, এত অল্পসংখ্যক উসমানি সৈন্য তাদের ওপর হামলা করার ধৃষ্টতা দেখাতে পারে। কিন্তু তাদের ধারণাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে উসমানি সেনা কমান্ডার ‘হাজি ইলবি’ তাদের ওপর অতর্কিত হামলা করে বসেন! কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের ভীতসন্ত্রস্ত করে ছত্রভঙ্গ করে দেন।
এ যুদ্ধে উসমানিদের বিজয়সংবাদ গোটা ইউরোপবাসীর ওপর বজ্রের মতো আপতিত হয়। ইউরোপকে উসমানিদের থেকে মুক্ত করার আশা দূরাশায় পরিণত হয়। তবু পোপ পঞ্চম এ্যারিয়েন (Adrian IV) গোটা ইউরোপকে উসমানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। 
কিন্তু ইউরোপবাসীর অন্তরে উসমানিদের ভয় এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, ইউরোপের কোনো সম্রাটই উসমানিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেওয়ার সাহস করতে পারেনি।
কিন্তু সার্বিয়া, বসনিয়া, আলবেনিয়া ও পোল্যান্ড এক বিশাল সম্মিলিত সেনাবহর প্রস্তুত করে। এ সেনাবহর সংখ্যায় এতই বেশি ছিল যে, ইউরোপের সবাই আশাবাদী হয়ে ওঠে। সবার মুখে মুখে প্রবাদ ছড়িয়ে পড়ে—যদি আকাশও আমাদের ওপর ভেঙে পড়তে চায়, আমরা অস্ত্রবলে সেটাকেও আটকিয়ে নেব! অবশেষে এক টানটান উত্তেজনাকর পরিস্থিতির পর উভয় বাহিনী মুখোমুখি হয়। কসোভোর ময়দানে। 
উসমানিবাহিনীর আগেই ইউরোপীয় বাহিনী ময়দানে পৌঁছে গিয়েছিল। তাই তারা ময়দানের উঁচু উঁচু টিলা আর পাহাড়গুলোতে সুবিধামতো অবস্থান নিয়ে সেনাশিবির স্থাপন করে। এতে যুদ্ধের ময়দানের সুবিধাজনক স্থান তাদের দখলে চলে যায়।
যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার আগের রাতে সুলতান প্রথম মুরাদ আকাশের দিকে হাত তুলে কায়মনোবাক্যে দুআ করতে থাকেন—
হে মাওলা, তোমার প্রিয় হাবিবের খাতিরে... কারবালার ময়দানে প্রবাহিত পবিত্র রক্তের খাতিরে.... তোমার ভয়ে ঝরা অশ্রুফোঁটাগুলোর খাতিরে... তোমার ভালোবাসায় সমাহিত চেহারাগুলোর খাতিরে তুমি মুসলিমদের সাহায্য করো। আমাদের ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দাও। আমাদের ভুলত্রুটির কারণে মুজাহিদদের পরাজিত করো না। ছত্রভঙ্গ করে দিয়ো না। জনগণের কাছে আমাদের অসহায় করে দিয়ো না।
ও মালিক, আমাকে তোমার দীনের জন্য উৎসর্গ করে দাও! তোমার রাস্তায় আমাকে শাহাদাতের জন্য কবুল করে নাও!
পরদিন সকালে ১৩৮১ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ জুন উভয় বাহিনী মুখোমুখি কাতারবন্দি হয়ে দাড়ায়। সুলতান প্রথম মুরাদ, তাঁর সুযোগ্য সন্তান ও উত্তরাধিকারী প্রথম বায়েজিদ, কমান্ডার ও মন্ত্রীবর্গ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তরবারি হাতে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রদর্শন করতে থাকেন বীরত্ব। 
শাহজাদা প্রথম বায়েজিদের তরবারির ভূমিকা ছিল একেবারে বজ্রাঘাতের মতো। তিনি শত্রুবাহিনীর কাতারের পর কাতার ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দুর্বার গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। তাঁর তরবারির আঘাতে কারও ধড় থেকে মাথা আলাদা হতে দেখা যায়; আর কাউকে অঙ্গ হারিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। 
তিনি বীরত্বের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন। তাঁর বীরত্ব ও সাহসিকতার কারণে ইতিহাস তাঁকে আজও 'ইয়ালদারম (বজ্রাঘাতকারী) উপাধিতে স্মরণ করে। কসোভোর যুদ্ধে তিনি তাঁর এ উপাধির যথার্থতা আবারও নতুন করে প্রমাণিত করেন।
সে দিন বিকেলেই শত্রুবাহিনী অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে পরাজয়বরণ করে। আবারও ইউরোপের দন্ত ও অহংকার চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। গোটা ইউরোপের জন্য কসোভোর ময়দান হয়ে যায় এক বিষাদময় উপত্যকার নাম।
পরদিন সুলতান প্রথম মুরাদ তাঁর কমান্ডার, মন্ত্রী ও সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধের মাঠ পরিদর্শনে বের হন। বিস্তৃত মাঠ জুড়ে লাশ আর লাশ। 
এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে দু-দলেরই লাশ। লাশগুলো চিল-শকুন খাবলে খাবলে খাচ্ছে। স্থানে স্থানে জমাটবাঁধা রক্তের দুর্গন্ধ আর মারাত্মক আহতদের গোঙানিতে সৃষ্টি হয়েছে এক বিভীষিকাময় পরিবেশ।
সুলতান প্রথম মুরাদ আহতদের খোঁজখবর নিতে পুরো মাঠ ঘুরতে থাকেন। যখনই কোনো আহত সৈন্য দৃষ্টিগোচর হতো, তাকে স্থানান্তরিত করে নিয়ে ব্যান্ডেজ- পট্টি বেঁধে দিয়ে চিকিৎসা করার নির্দেশ দিতেন।
পুরো মাঠে তিনি আহতদের খোঁজখবর নিচ্ছিলেন, ইত্যবসরে এক কমান্ডার এসে
তাকে জানায়,
—সুলতান, ওখানে লাশের সারিতে একজন সার্বিয়ান সেনা আহত হয়ে পড়ে আছে। সে আপনার চেহারা অবলোকন করে ধন্য হতে চায় এবং আপনার হাতেই ইসলাম গ্রহণ করতে চায়।
-কোথায় সে?
– ওই তো, ওখানে সুলতান।
-চলো, আমরা ওদিকে যাই তাহলে। ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিতে আগ্রহী সৈন্যকে আমরা বরণ করে নিই।
আহত সৈন্যটি ছিল সার্বিয়ার এক চতুর সৈন্য। নাম মিলোস অবিলিচ। সে মারাত্মক আহত ছিল। সে প্রকৃতপক্ষে ইসলামগ্রহণে আগ্রহী ছিল না; বরং মুসলিমদের সুলতান প্রথম মুরাদের ব্যাপারে এক দুরভিসন্ধি করে রেখেছিল, যিনি কসোভোর ময়দানে গোটা ইউরোপের মুখাবয়বে আবারও পরাজয়ের চুনকালি মেখে দিয়েছেন।
আহত সার্বিয়ান সৈন্যটি তার ইউনিফর্মের ভেতরে একটি ধারালো খঞ্জর লুকিয়ে রেখেছিল। সুলতান যখন সার্বিয়ান ওই সৈন্যটির দিকে এগিয়ে গেলেন, তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন শাহজাদা বায়েজিদ, সালতানাতের মন্ত্রী, কমান্ডার এবং কিছু সৈন্য। সুলতানকে দেখেই সৈন্যটি উঠে দাঁড়ায়। সুলতানের দিকে এক-কদম দু- কদম করে এগিয়ে যায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল, সে সুলতানের হাতে চুমু খেতে আগ্রহী। কিন্তু না, হতভাগাটা সুলতানের নিকটবর্তী হতেই চোখের পলকে লুকিয়ে রাখা খঞ্জর বের করে সুলতানের বুকে সজোরে বিধে দেয়! মুহূর্তের মধ্যেই সুলতান মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। উপস্থিত সবাই ঘটনার আকস্মিকতায় একেবারে হতভম্ব হয়ে যায়! 
এ কী!!
হতভাগা ইসলাম গ্রহণের কথা বলে মহামান্য সুলতানকে শহিদ করে দিলো! 
আঘাত খুব গভীর ছিল। ব্যথার তীব্রতায় সুলতান মুখ দিয়ে কিছুই উচ্চারণ করতে পারছিলেন না। অস্পষ্টস্বরে শুধু একটি কথাই বলেন— 'এটাই আমার তাকদির... বায়েজিদ যেন আমার উত্তরাধিকারী হয়...।'
এরপর সুলতান প্রথম মুরাদ কালিমায়ে শাহাদাত পাঠ করে চিরতরের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে যান। এভাবেই আল্লাহ তাআলা সুলতান প্রথম মুরাদের ইচ্ছা পূর্ণ করেছিলেন। তাঁকে দান করেছিলেন শাহাদাতের মহান মর্যাদা। এরপর উসমানিরা সুলতানের মরদেহ বহন করে বুরসা অভিমুখে যাত্রা করে।
আর ওই সার্বিয়ান সৈন্য? তাকে সেখানেই উপস্থিত উসমানি সৈন্যরা তরবারির উপর্যুপরি আঘাতে টুকরো টুকরো করে দেয়।*

       সিরিজ: ওসমানী খেলাফতের স্বর্ণ কণিকা

                        © Ofde islam 



Post a Comment

0Comments

Thanks everyday

Post a Comment (0)
To Top