ওসমানী খেলাফতের এক সুলতান ও তার ভাড়। ওসমানী খেলাফতের স্বর্ণ কণিকা, ofde islam

1



সুলতান ও ভাঁড়


১৩৯৩ খ্রিষ্টাব্দের কাহিনি। উসমানি খিলাফত উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে তীব্রবেগো অগ্রসর হচ্ছে। খিলাফতের মসনদে সমাসীন আছেন সুলতান প্রথম বায়েজিদ ইয়ালদারম।

সুলতানের একটি অভ্যাস ছিল, তিনি রাজধানী বুরসার বাইরে যে অঞ্চলেই যেতেন, কিছুদিন অবস্থান করে সেখানকার মানুষের সুখ-দুঃখ ও অভিযোগ- অনুযোগ শুনতেন। অস্থায়ী, সাময়িক আদালত গঠন করে বিচার করতেন। তদানীন্তন সময়ে এ আদালতকে 'আয়াক দেওয়ানি' বলা হতো।

এমনই একটি অস্থায়ী আদালতে বসে তিনি বিচারকার্য পরিচালনা করছিলেন। এরই মধ্যে আদালতে একজন বৃদ্ধার আগমন হয়। এসেই তিনি চিৎকার করে অভিযোগ করতে শুরু করেন। সুলতান বৃদ্ধাকে কাছে ডেকে তার সমস্যার কথা স্পষ্ট করে বলতে বলেন। বৃদ্ধা বলেন, 'মহামান্য সুলতান, আপনার একজন কর্মকর্তা আমার ওপর জুলুম করেছে।' -সে কী করেছে? আপনি নির্ভয়ে বলুন।

-সে এসে আমার অনুমতি ছাড়াই আমার দোহনকৃত দুধ পান করে নিয়েছে।

কিন্তু আমি যখন তাকে দুধের মূল্য পরিশোধ করতে বলি, সে আমাকে ধমক দিয়ে গালাগালি শুরু করে। আমি মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে গিয়ে অবস্থার কথা জানালে তিনি স্থানীয় কিছু মানুষের সাহায্যে সেই কর্মকর্তাকে ধরে কাজির কাছে নিয়ে যান। কিন্তু মহামান্য সুলতান, কাজি তাকে নির্দোষ সাব্যস্ত করে ছেড়ে দেন। আমি জুলুমের শিকার হয়েছি, সুলতান, আমি আমার অধিকার চাই!' সুলতান ওই কর্মকর্তাকে ধরে নিয়ে আসতে কিছু লোক পাঠান। তারা সেই কর্মকর্তাকে ধরে সুলতানের দরবারে হাজির করে। ভয়ে কর্মকর্তা থরথর করে কাঁপছে! সুলতান তাকে প্রশ্ন করেন, তুমি কি এমনকিছু করেছিলে?'

ভয়ে কম্পমান কর্মকর্তা উত্তরে বলে, 'আমাকে ক্ষমা করুন সুলতান, আমি শয়তানের প্ররোচনায় এমনটা করেছিলাম। বৃদ্ধা মা যা চান, আমি তা আদায় করে দেবো। আল্লাহর শপথ, এমন কাজ আর কখনো করব না, আমাকে ক্ষমা করে দিন সুলতান।”

তাহলে তো অভিযোগ সত্য। অপরাধীকে অবশ্যই শান্তি পেতে হবে। আর শান্তি দিয়েই কি বিষয়টি শেষ? না, মোটেই না; বরং বিষয়টি সুলতানের কাছে আরও মারাত্মক মনে হলো। সুলতান ভেবে আশ্চর্যবোধ করেন, এমন অপরাধীকে কাজি কীভাবে মামলা থেকে মুক্তি দিয়ে দেয়, যেখানে তার অপরাধও প্রমাণিত, আবার সাক্ষীও বিদ্যমান! কীভাবে? তাহলে কী কাজিই ঘুস খেয়েছে?

সুলতান তাঁর সামনে নতশিরে দাঁড়ানো আসামির দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে ভারতে থাকেন। তারপর তাকে জিজ্ঞেস করেন, "তুমি কি কাজিকে ঘুস দিয়েছিলে?' -না, সুলতান। আমি তাকে ঘুস দিইনি; তবে আমি তাকে বলেছিলাম, আমি

একজন সরকারি কর্মকর্তা। তাই তিনি আমাকে ক্ষমা করে মুক্তি দিয়ে দেন।' সুলতান রাগে দাঁতে দাঁত পিষে বলেন, 'যে ব্যক্তি মানুষের ওপর জুলুম করে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না। তার তাওবাও কবুল করেন না। তাহলে কাজি কীভাবে এই কর্মকর্তাকে ক্ষমা করতে পারল, যে কিনা একজন মানুষের ওপর জুলুম করেছে? তোমরা যাও, সেই কাজিকে আমার সামনে উপস্থিত করো।'

সুলতানের নির্দেশ শুনতেই কিছু লোক সেই কাজিকে ধরে আনতে যায়। সুলতান তাঁর প্রধান দেহরক্ষীর দিকে তাকিয়ে বলেন, “তুমি তোমার লোকজনকে জড়ো করো। শহরের প্রতিটি ঘরের দরজায় করাঘাত করো; আর প্রত্যেক এমন মজলুমের নাম তালিকাভুক্ত করো, যাদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে কাজি বা আদালতের বিরুদ্ধে। এরপর তা আমাকে জানাও! আমার জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা ফরজ।' প্রধান দেহরক্ষী কয়েকদিন পর সুলতানের সামনে একটি তালিকা পেশ করে, যেখানে কাজি বা আদালতের বিরুদ্ধে অভিযোগকারীদের নাম ছিল।

সুলতান তালিকায় নজর বুলাতেই এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। কারণ, তালিকায় দু- চারজন নয়; অসংখ্য মানুষের নাম বিদ্যমান! এরপর সুলতান আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, ' এর অর্থ কি এই নয় যে, আমরা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে উপনীত হয়েছি? রাজধানী বুরসায় পৌঁছেই সুলতান বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নর ও শাসকদের প্রতি এই ফরমান জারি করেন-

আমি আপনাদের প্রতি এই নির্দেশ দিচ্ছি যে, কালবিলম্ব না করে আপনারা আমার কাছে আপনাদের অধীনস্থ প্রতিটি গ্রাম, শহর ও দুর্গের সেই কাজির নাম লিখে পাঠাবেন, যার ব্যাপারে শরিয়তবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার অথবা ঘুস গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে।

সুলতানের রাগ দেখে উজিরে আজম জান্দারলি পাশা অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েন।

অভিযুক্ত কাজিদের সুলতান কী শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেবেন, তা জানতে চান। সুলতান তাকে বলেন, 'একটি সাম্রাজ্য থেকে ন্যায়বিচার দূর হয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে সেই সাম্রাজ্যের পতন ঘটা। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, অভিযুক্ত কাজিদের একটি ঘরে ঢুকিয়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার ফায়সালা দেবো।'

সুলতানের এই জবাবটি উজিরে আজমের মাথায় যেন বজ্রাঘাত করে। অন্য উজিররাও কথাটি শুনে ভড়কে যান। সবাই বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে। কিন্তু কে এমন আছে, সুলতানের নেওয়া সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করবে?

হ্যাঁ, এখানে একজন লোক আছে, যে কিনা এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও সুলতানের সঙ্গে কথা বলতে পারবে। সে হচ্ছে, রাজভাড়। তার কাজ হচ্ছে, রসিকতার মাধ্যমে সুলতানকে বিনোদিত করা। যার ভাঁড়ামি আর রসিকতায় সুলতান না হেসে পারেন না। কখন কীভাবে সুলতানকে হাসাতে হয়, খুব ভালোভাবেই তার জানা আছে।

উজিরে আজম রাজভাড়কে ডেকে পাঠান। রাজভাড় আসার পর তাকে সবকিছু খুলে বলেন। সব শুনে রাজভাড় বলে, 'পাশা! আপনি চিন্তিত হবেন না। বিষয়টি একেবারে সহজ!

পরদিন রাজভাঁড় সফরের কাপড়চোপড় পরে সুলতানের খাস কামরায় এসে

উপস্থিত। তাকে দেখতেই সুলতান মুচকি হাসি দেন। আর তার পরনে সফরের কাপড় দেখে জিজ্ঞেস করেন, 'কী ব্যাপার, তুমি কি কোথাও যাচ্ছ?'

—জি, সুলতান। সফরের অনুমতি নিতেই আপনার দরবারে এসেছি।'

-কোথায় যাচ্ছ?

— কনষ্টান্টিনোপল যাব, সুলতান।

-সেখানে কেন?

-সেখান থেকে কয়েক ডজন পাদরিকে বুরসায় নিয়ে আসব!

ভ্রু কুঞ্চিত করে সুলতান জিজ্ঞেস করেন, 'এত পাদরি ও যাজক বুরসায় নিয়ে আসবে? বুরসায় কেন? বুরসায় এদের কাজ কী আবার?'

তারা বিচারকার্য পরিচালনা করবে, সুলতান।

—তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? পাদরি ও যাজকরা কেন বিচারক হতে যাবে? আমাদের কাছে কি বিচারক নেই?'

—এখানে তো কোনো বিচারক বাকি থাকবে না। বিচারকদের তো আপনি আগুনে পুড়িয়ে শাস্তি দেওয়া সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। মুসলমানদের বিচার-আচার তো আর বন্ধ থাকতে পারে না; তাই আমি ভাবলাম, কনস্টান্টিনোপল থেকে পাদরি এনে তাদের দিয়েই এ শূন্যতা পূরণ করি। যেমনই হোক না কেন, তারাও তো আলিম!

রাজভাড়ের কথা শুনে সুলতান হেসে ফেলেন। তিনি অনুভব করতে পারেন যে, বিচারকদের ব্যাপারে আসলেই তিনি কঠিন শাস্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এরপর সুলতান রাজভাড়কে বলেন, 'ভালো! ভালো! আমি আমার সিদ্ধান্ত থেকে

সরে এসেছি। সম্ভবত আমি এ বিষয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলছি। যে-সকল

উজির তোমাকে এখানে পাঠিয়েছেন, তাদের নিশ্চিন্ত থাকতে বলো।'

এরপর সুলতান প্রথম বায়েজিদ অভিযুক্ত বিচারকদের সমীচীন শাস্তি প্রদান করেন। 

© Ofde islam



Post a Comment

1Comments

Thanks everyday

Post a Comment
To Top