কুরআনের গুরুত্ব: জীবনযাত্রার আলোকবর্তিকা ।

0
কোরআনের গুরুত্ব..
কুরআন, ইসলামের মূলগ্রন্থ, যা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য সর্বশেষ হিদায়াত হিসেবে প্রেরিত হয়েছে। এটি আমাদের জীবনের সকল ক্ষেত্রে সঠিক পথের দিকনির্দেশনা প্রদান করে। কুরআন শুধু ধর্মীয় বিধান নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা যা মানবতার জন্য শান্তি, কল্যাণ এবং সফলতার উপায় বর্ণনা করে। সাহাবায়ে কেরাম, যারা প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সঙ্গী ছিলেন, তাদের জীবন ছিল কুরআন ও হাদিসের অনুসরণে পরিপূর্ণ। তারা কুরআনের সাথে অগাধ সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন এবং কুরআন, হাদিসের শিক্ষা তাদের জীবনের প্রতিটি দিককে আলোকিত করেছিল। সাহাবাগণ কুরআনের বাণীকে হৃদয়ে ধারণ করে তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতেন এবং এর প্রতি তাদের গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল। সাহাবায়ে কেরামের জীবন আমাদের সামনে কুরআনের গুরুত্ব সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরে। তাদের জীবন কুরআনের অনুসরণে পূর্ণ ছিল, যা আমাদের জন্য এক মহান উদাহরণ হয়ে আছে। কুরআন ও হাদিসেও কুরআনের গুরুত্ব নিয়ে বহু বর্ণনা রয়েছে,

1️⃣ কোরআন তেলাওয়াতের গুরুত্ব ও ফজিলত

১. কোরআন তেলাওয়াত আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশিত

আল্লাহ তাআলা কোরআনে বলেছেন—

"যারা কিতাব পাঠ করে, নামাজ কায়েম করে এবং আমি যা দিয়েছি তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারা এমন ব্যবসার আশা করে যা কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।"

(সূরা ফাতির: ২৯)


২. কিয়ামতের দিনে সুপারিশ করবে

হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন—

إَنْ أَبِي أُمَامَةَ الْبَاهِلِيِّ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ يَقُولُ: "اقْرَءُوا الْقُرْآنَ، فَإِنَّهُ يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ شَفِيعًا لِأَصْحَابِهِ

(رواه مسلم: 804)

 বাংলা অনুবাদ:

"কোরআন পড়ো, কারণ তা কিয়ামতের দিন তার পাঠকের জন্য সুপারিশকারী হিসেবে উপস্থিত হবে।"

(সহিহ মুসলিম: ৮০৪)


৩. প্রতি অক্ষরের জন্য সওয়াব

রাসুল (সা.) বলেছেন—

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ:

"مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ، وَالْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا، لَا أَقُولُ: (الٓمٓ) حَرْفٌ، وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ، وَلَامٌ حَرْفٌ، وَمِيمٌ حَرْفٌ."

বাংলা অনুবাদ:

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ বলেছেন:

যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাবের একটি অক্ষর পড়ে, তার জন্য এক নেকি রয়েছে, আর প্রতিটি নেকি দশ গুণ বৃদ্ধি করা হয়। আমি বলছি না যে 'আলিফ-লাম-মীম' একটি অক্ষর; বরং আলিফ একটি অক্ষর, লাম একটি অক্ষর, এবং মীম একটি অক্ষর।

(সুনান আত-তিরমিজি: ২৯১০, সহীহ)


৪. অন্তর প্রশান্তি লাভ করে

আল্লাহ তাআলা বলেন—

"নিশ্চয়ই আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমে হৃদয় প্রশান্তি লাভ করে।"

(সূরা রাদ: ২৮)


৫. মর্যাদা বৃদ্ধি পায়

রাসুল (সা.) বলেছেন—

عَنْ عُثْمَانَ رَضِيَ اللَّةُ عَنْهُ قَالَ:

"قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ: "خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ."

বাংলা অনুবাদ:

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ বলেছেন:

"তোমাদের মধ্যে সেরা সেই ব্যক্তি, যে কুরআন শিখে এবং অন্যদের শেখায়।"

(সহীহ বুখারী: ৫০৪৩)

"তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সর্বোত্তম, যে কোরআন শেখে এবং অন্যকে শেখায়।"

(সহিহ বুখারি: ৫০২৭-৫০২৮ )


৬. জান্নাতে উচ্চ মর্যাদা লাভ

হাদিসে এসেছে—

حَدَّثَنَا مُسَدَّدٌ، حَدَّثَنَا يَحْيَى، عَنْ سُفْيَانَ، حَدَّثَنِي عَاصِمُ بْنُ بَهْدَلَةَ، عَنْ زِرٍّ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ "‏ يُقَالُ لِصَاحِبِ الْقُرْآنِ اقْرَأْ وَارْتَقِ وَرَتِّلْ كَمَا كُنْتَ تُرَتِّلُ فِي الدُّنْيَا فَإِنَّ مَنْزِلَكَ عِنْدَ آخِرِ آيَةٍ تَقْرَؤُهَا ‏"‏ ‏.‏

 বাংলা অনুবাদ:

"যে ব্যক্তি কোরআন পাঠ করবে এবং তা অনুসরণ করবে, তার জন্য কিয়ামতের দিন বলা হবে, ‘তিলাওয়াত করো এবং ওপরে উঠতে থাকো, তুমি যেমন দুনিয়াতে পাঠ করতে, তেমনি পড়তে থাকো, কারণ তোমার স্থান নির্ধারিত হবে যেখানে তুমি সর্বশেষ আয়াত পাঠ করবে।"

(আবু দাউদ: ১৪৬৪, তিরমিজি: ২৯১৪)


৭. গোনাহ মাফের মাধ্যম

রাসুল (সা.) বলেছেন—

مَن قَرَأَ عَشْرَ آيَاتٍ فِي لَيلَةٍ لَم يُكتَبْ مِنَ الغَافِلِينَ

"যদি কোনো ব্যক্তি রাতে কোরআনের দশটি আয়াত তেলাওয়াত করে, তবে সে গাফিলদের অন্তর্ভুক্ত হবে না।"

(এই হাদিসটি মুস্তাদরাকে হাকেম (১/৭৪২) থেকে বর্ণিত এবং ইমাম হাকেম বলেন যে এটি ইমাম বুখারী ও মুসলিম রহ. এর শর্ত মোতাবেক সহীহ, যদিও তারা তাদের গ্রন্থে এটি উল্লেখ করেননি। এছাড়া, ইমাম আলবানী রহ. এই হাদিসটিকে ‘সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব’ কিতাবে সহীহ হিসেবে উল্লেখ করেছেন (২/৮১)

2️⃣ সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীদের জীবনে কোরআনের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব :
 
সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীগণ ছিলেন কোরআনের প্রকৃত অনুসারী। তাঁরা কেবল কোরআন তেলাওয়াত করতেন না, বরং কোরআনের শিক্ষা অনুসারে নিজেদের জীবন পরিচালনা করতেন। তাঁদের জীবনে কোরআনের গুরুত্ব অপরিসীম ছিল, যা তাঁদের আমল, চরিত্র, বিচার-ব্যবস্থা ও সমাজ গঠনে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
 
১. কোরআন শিক্ষা ও প্রচারে তাঁদের আগ্রহ
সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীগণ কোরআন শিখতে এবং শেখাতে গভীর আগ্রহী ছিলেন।
🔹 আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেছেন—
"যে ব্যক্তি কোরআন শিখতে চায়, সে যেন আমাদের মতো শিখে, কারণ আমরা কোরআন শিখেছি নবীজির নিকট থেকে সরাসরি।"
 
২. কোরআন তেলাওয়াতের প্রতি তাঁদের গুরুত্ব
সাহাবারা কোরআন তেলাওয়াতকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন এবং কোরআনের প্রতিটি শব্দে গভীর মনোযোগ দিতেন।
🔹 "উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) এক রাতে কোরআন তেলাওয়াত করতে গিয়ে সূরা তোবা-এর একটি আয়াত শুনে এতটাই প্রভাবিত হন যে, তিনি কেঁদে ফেলেন এবং অসুস্থ হয়ে পড়েন।"
 
৩. কোরআনের নির্দেশ বাস্তবায়নে তাঁদের আন্তরিকতা
সাহাবারা কোরআনের হুকুম অনুযায়ী নিজেদের জীবন পরিচালনা করতেন।
🔹 "উমর এবং সকল  খলিফা সাহাবি (রা.) খিলাফত চলাকালীন বিচারকার্য পরিচালনা করতেন কোরআনের বিধান অনুসারে।"
 
🔹 আবু বকর (রা.) খিলাফতের শুরুতে ঘোষণা করেন—
"আমি যদি কোরআন ও নবীর সুন্নাহ অনুসারে চলি, তবে আমার আনুগত্য করো। আর যদি আমি পথভ্রষ্ট হই, তবে আমাকে সংশোধন করো।"
 
৪. কুরআনের একটি আয়াতেই যথেষ্ট ছিল তাদের জীবন পরিবর্তনে :
🔹 হজরত ওমর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন কোরআনের কিছু আয়াত শুনে (সূরা ত্বা-হা: ১৩-১৪)।
🔹 ফুজাইল ইবনে আইয়াজ ছিলেন এক দস্যু, কিন্তু এক রাতে তিনি শুনলেন—
"তবে কি সে সময় আসেনি, যখন মুমিনদের অন্তর কেঁপে উঠবে আল্লাহর স্মরণে?" (সূরা হাদিদ: ১৬)
এই আয়াত শুনে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং জীবনের পরিবর্তন আনেন।
 
৫. তাবেয়ীদের কোরআন অধ্যয়নের প্রতি মনোযোগ
🔹 হাসান বসরি (রহ.) বলতেন—
"সাহাবারা কোরআনের একটি আয়াত মুখস্থ করলে তা বাস্তবায়ন না করা পর্যন্ত অন্যটি মুখস্থ করতেন না।"
🔹 ইমাম আবু হানিফা (রহ.) রাতে দীর্ঘ সময় কোরআন তেলাওয়াত করতেন এবং এক রাতে সূরা বাকারা পড়েই কাটিয়ে দিতেন।

3️⃣ কোরআনের নির্দেশনা অনুসরণের প্রভাব উপকারিতা:

আত্মার প্রশান্তি ও পথনির্দেশ: কোরআন পড়লে ও বুঝলে মানুষের মন শান্তি পায়, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূর হয় এবং জীবন সুন্দর ও সহজ হয়ে যায়।
নৈতিকতা ও চারিত্রিক উন্নতি: কোরআন মানুষের চরিত্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি সত্যবাদিতাধৈর্যনম্রতাদয়াক্ষমা প্রভৃতি গুণাবলির শিক্ষা দেয়।
বিজ্ঞান ও জ্ঞানচর্চা: কোরআনে অনেক বৈজ্ঞানিক তথ্য ও বাস্তব সত্য তুলে ধরা হয়েছেযা যুগে যুগে মানুষকে নতুন নতুন আবিষ্কারের দিকে পরিচালিত করেছে।
জীবন বিধান: এটি কেবল নামাজ, রোজা, হজ ও যাকাতের মতো ইবাদতের কথা বলে না, বরং অর্থনীতি, সমাজনীতি, আইন, ন্যায়বিচারসহ জীবনের সব ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা দেয়।
আখিরাতের সফলতা: কোরআনের শিক্ষা অনুসরণ করলে মানুষ জান্নাতের অধিকারী হবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করবে।
 
ব্যক্তি ও সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়।
✅ অন্যায়, অশান্তি ও বিভ্রান্তি দূর হয়।
✅ পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়।
✅ আল্লাহর ভালোবাসা ও রহমত লাভ হয়।

সমাপ্তি :

কোরআন তেলাওয়াত কেবল সওয়াব অর্জনের মাধ্যম নয়, বরং এটি মুমিনের জীবনের পাথেয়, গাইডলাইন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের গুরুত্বপূর্ণ উপায়। সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীগণের জীবনে কোরআনের প্রভাব ছিল গভীর ও সুদূরপ্রসারী। তাঁরা কোরআন শুধু পড়তেন না, বরং প্রতিটি আয়াতের উপর চিন্তা করতেন, তা নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করতেন এবং সমাজে ছড়িয়ে দিতেন। আমাদেরও উচিত তাঁদের মত কোরআনের প্রতি গভীর ভালোবাসা রাখা ও আমল করা।

Ofde islam
আল হামিম হোসেন
Guest Writer - ঢাকা


Post a Comment

0Comments

Thanks everyday

Post a Comment (0)
To Top