একটি হত্যা, এক বিশ্বশক্তির কু-নাট্য: গাদ্দাফির গল্প

0


মুআম্মর গাদ্দাফি: জীবন, শাসনকাল এবং লিবিয়ার পুনর্গঠন


পরিচিতি ও নাম:

পূর্ণ নাম:

🔹 বাংলা: মুআম্মার মুহাম্মাদ আবু মিনিয়ার আল-গাদ্দাফি

🔹 আরবি: معمر محمد أبو منيار القذافي

🔹 ইংরেজি: Muammar Muhammad Abu Minyar al-Gaddafi

গাদ্দাফি ছিলেন লিবিয়ার দীর্ঘকালীন নেতা, যিনি ১৯৬৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত দেশ শাসন করেন।


জন্ম ও প্রাথমিক জীবন:

মুআম্মর গাদ্দাফি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪২ সালের ৭ জুন লিবিয়ার সর্জা (Sirt) গ্রামে, যা ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলে অবস্থিত। তার পরিবার বেদুইন উপজাতির অন্তর্ভুক্ত ছিল, যাদের জীবনযাত্রা ছিল সাধারণ কৃষক ও পশুপালকের মতো। ছোটবেলা থেকেই গাদ্দাফির মধ্যে ছিল দেশপ্রেম এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা।


শিক্ষাজীবন:

অন্যসব লিবিয়ান শিশুর মতো তিনিও শৈশবে  স্থানীয় ইসলামি বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং কুরআন শিক্ষায় দক্ষ হন। এরপর তিনি ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত ফেজান এর সাবহা প্রিপারেটরি স্কুলে অধ্যয়ন করেন। সেখানে অধ্যয়ন কালে তিনি এবং তার কতিপয় বন্ধু সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে লিবিয়ার শাসন ক্ষমতা দখল করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু তার এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই ১৯৬১ সালে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়তার অভিযোগে তাকে সাবহা থেকে বহিষ্কার করা হয়।

সাবহা থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তিনি বেনগাজীর তত্‍কালীন ইউনিভার্সিটি অব লিবিয়াতে (পরবর্তীতে যেটা বেনগাজীর আল ক্বারিউনেস এবং ত্রিপলীর আল ফাতাহ এই দুই ইউনিভার্সিটিতে বিভক্ত হয়ে যায়) ভর্তি হন এবং উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। এরপর ১৯৬৩ সালে তিনি বেনগাজীর সামরিক পরিষদে যোগদান করেন। সেখানে তিনি এবং তার অনুগত কতিপয় সামরিক কর্মকর্তা লিবিয়ার পশ্চিমমুখী রাজতন্ত্রকে (সেনুসীয় রাজতন্ত্র) উৎখাত করার জন্য একটি গোপন দল গঠন করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি উচ্চ প্রশিক্ষণের জন্য ব্রিটেনে যান এবং ১৯৬৬ সালে কমিশন প্রাপ্ত অফিসার পদে উন্নীত হয়ে লিবিয়ায় ফিরে আসেন।


 গাদ্দাফির পারিবারিক জীবন:

গাদ্দাফি তার স্ত্রী সাফিয়া ফিরকাশ-কে বিয়ে করেন, যিনি ছিলেন একজন নার্স।

তাদের ৮–১০ জন সন্তান ছিল (মতভেদ রয়েছে)। উল্লেখযোগ্য সন্তানরা:

সাইফ আল-ইসলাম গাদ্দাফি – রাজনীতিতে সক্রিয়, পশ্চিমাদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের মুখ

মুতাসিম বিল্লাহ – নিরাপত্তা উপদেষ্টা, ন্যাটো অভিযানে নিহত

খামিস গাদ্দাফি – সামরিক বাহিনীর কমান্ডার, ২০১১ সালে নিহত

সেইফ আল-আরাব – ২০১১ সালে ন্যাটো হামলায় নিহত

তার এক মেয়ে ছিলেন আইশা গাদ্দাফি, যিনি আইনবিদ ও জাতিসংঘে লিবিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেন।


 🟢 গাদ্দাফির রাজনৈতিক অভ্যুত্থান ও আদর্শ-

 ক্ষমতায় আসা:

১৯৬৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর, গাদ্দাফি সেনাবাহিনীর এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইদরিস সানুসি বাদশাহকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেন। এই অভ্যুত্থানে গাদ্দাফি কেবল এক সেনা অফিসার ছিলেন না  , বরং নতুন যুগের নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি দেশকে ‘লিবিয়ান আরব গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক জমানা’ হিসেবে ঘোষণা দেন।


তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের মূল ভিত্তি ছিল:

🔸 ইসলামিক সমাজবাদ

🔸 আফ্রিকান ঐক্যবাদ

🔸 পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা

🔸 জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর (People’s Authority) – তিনি “গণতন্ত্র” নয়, “জামাহিরিয়া” প্রতিষ্ঠার কথা বলেন।


গাদ্দাফির প্রধান লক্ষ্য ছিল:

লিবিয়াকে স্বাধীন, শক্তিশালী ও স্বনির্ভর রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা।

আরব ও আফ্রিকান উম্মাহর ঐক্য ও মুক্তি সাধন।

পশ্চিমা উপনিবেশবাদ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ।

দেশ ও জনগণের মধ্যে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা।


শাসনকাল এবং দেশ ও জনগণের জন্য তার অবদান:

🟢 গাদ্দাফির শাসনামলে লিবিয়ার উন্নয়ন ও জনগণকে দেওয়া উপহারসমূহ

মুআম্মার গাদ্দাফির নেতৃত্বে (১৯৬৯–২০১১) লিবিয়া বিশ্বের এক দরিদ্র দেশ থেকে আফ্রিকার মধ্যে সর্বোচ্চ মানবিক উন্নয়ন সূচক অর্জনকারী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। পশ্চিমারা যাকে "স্বৈরাচারী" বলে অপবাদ দেয়, সেই গাদ্দাফির আমলেই লিবিয়ার সাধারণ জনগণ পেয়েছিল এমন কিছু অধিকার ও সুযোগ, যা অনেক তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও ছিল না।


🏠 ১. বাসস্থান – বিনামূল্যে ঘর-বাড়ি:

গাদ্দাফি বিশ্বাস করতেন, "কোনও ব্যক্তি ভাড়া দিয়ে ঘুমাবে না, ঘর তার অধিকার"। তাই সরকার বিনামূল্যে আবাসনের ব্যবস্থা করতো এবং বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস ছিল ফ্রি 
নতুন বিবাহিত দম্পতির জন্য সরকারি ঘর বরাদ্দ দিত।
কেউ ঘর বানাতে চাইলে তাকে সরকার জমি ও আর্থিক সহায়তা দিত।

গাদ্দাফির নীতিমালায় স্পষ্ট ছিল:
> "A house is a basic human right."


 ২. শিক্ষা – সম্পূর্ণ ফ্রি ও আন্তর্জাতিক মানের:

গাদ্দাফি মনে করতেন, "শিক্ষা প্রতিটি মানুষের অধিকার"। তাই তাঁর শাসনামলে লিবিয়ায় সরকারি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পুরোপুরি বিনামূল্যে শিক্ষা দেওয়া হতো।
ছাত্রদের জন্য বই, ইউনিফর্ম, যাতায়াত সবকিছু ফ্রি।
যারা বিদেশে পড়তে চাইত, সরকার তাদের স্কলারশিপ দিয়ে ইউরোপ/আমেরিকায় পাঠাত এবং পুরো খরচ বহণ করতো লিবিয়া সরকার।


 ৩. স্বাস্থ্যসেবা – সম্পূর্ণ ফ্রি চিকিৎসা ব্যবস্থা:

দেশজুড়ে উন্নত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়, এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ বিনামূল্যে।
বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজন হলে যাতায়াত খরচ সহ সব ধরনের ব্যয়  সরকার বহন করতো


 ৪. তেল ও জ্বালানি – জনগণের সম্পদ হিসেবে বন্টন:

লিবিয়া ছিল আফ্রিকার অন্যতম তেল-সমৃদ্ধ দেশ। গাদ্দাফি তেল কোম্পানিগুলোকে জাতীয়করণ করে তেলের আয় জনগণের উন্নয়নে ব্যয় করতেন।
তেলের আয় থেকে নাগরিকদের অ্যাকাউন্টে বার্ষিক ভাতা প্রদান করা হতো।

একটি দম্পতি বিয়ের পর গাড়ি কেনার জন্য সরকারি অনুদান পেত।


 ৫. আর্থিক সুবিধা ও ব্যাংক ঋণ:

ইসলামী অর্থনীতির অনুকরণে, গাদ্দাফি সুদ (interest) সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেন এবং একটি সুদমুক্ত ব্যাংক ব্যবস্থা গড়ে তোলেন।
প্রতি নবদম্পতিকে ৫০,০০০ ডলার অনুদান দেওয়া হতো ঘর বানানোর জন্য।
বেকারদের জন্য মাসিক ভাতা প্রদান।


৬.আফ্রিকান ঐক্য এবং স্বর্ণ দিনার (Gold Dinar) প্রকল্প:

গাদ্দাফি আফ্রিকান দেশগুলোকে একত্রিত করে একটি শক্তিশালী আফ্রিকান ইউনিয়ন গঠন করতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন স্বর্ণ-ভিত্তিক মুদ্রা চালু করতে – যা হতো ডলারের বিকল্প।

গাদ্দাফি প্রস্তাব দেন, আফ্রিকার সব দেশ এক মুদ্রায় বাণিজ্য করবে – “গোল্ড দিনার”।
এটি পশ্চিমা দুনিয়ার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় কারণ তাতে ডলারের প্রভাব বাজেভাবে কমে যেত।


 ৭. কৃষি ও পানি – মরুভূমিকে সবুজ করার প্রকল্প:

"Great Man-Made River Project" নামে বিশাল পানি সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়
এই প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের পানি সরবরাহ করা হয়, যাতে মরুভূমিতে চাষাবাদ সম্ভব হয়।
কৃষকদের জন্য বিনামূল্যে জমি, কৃষি যন্ত্রপাতি ও বীজ সরবরাহ করত সরকার।
এটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপলাইন সিস্টেম (প্রায় ২,৮০০ কিমি)।


 ৮. বিদেশ ভ্রমণ ও হজ্ব সুবিধা:

লিবিয়ার নাগরিকরা সরকারিভাবে বছরে নির্দিষ্ট কোটা অনুযায়ী হজ করতে যেতেন, পুরো খরচ সরকার দিত।
পাসপোর্ট সহজলভ্য ও ভিসা প্রক্রিয়া সহজ ছিল।


 ৯. বড় বড় প্রকল্প ও অবকাঠামো উন্নয়ন:

আন্তর্জাতিক মানের মেডিকেল সেন্টার, বিশ্ববিদ্যালয়, রাস্তাঘাট, শহর উন্নয়ন।
Tripoli ও Benghazi-কে আন্তর্জাতিক নগরীতে রূপান্তর করার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়।


 ১০. নিরাপত্তা ও অপরাধ দমন:

গাদ্দাফির শাসনকালে লিবিয়ার আইন-শৃঙ্খলা চমৎকার ছিল।
গণহত্যা, গণধর্ষণ, দুর্নীতি, সন্ত্রাসবাদের কোনো স্থান ছিল না।


১১. খাদ্য ও পণ্যের দাম ছিল কম:

তেল আয়ের সুবাদে সরকার জরুরি পণ্যে ভর্তুকি দিত, ফলে খাদ্যদ্রব্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে ছিল।
এক বোতল জ্বালানি বা গ্যাসের দাম ছিল বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম।
গাড়ির জ্বালানি – প্রতি লিটার মাত্র ০.১৪ ডলার!
চাল, আটা, চিনি, তেল — সব কিছুই সাশ্রয়ী দামে পাওয়া যেত।

১২.নারী অধিকার ও উন্নয়ন:

গাদ্দাফির শাসনে নারীরা শিক্ষা, চাকরি ও সেনাবাহিনীতে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। নারীদের জন্য আলাদা স্কুল, কলেজ ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল।

তাঁর নারী দেহরক্ষী বাহিনী ছিল বিশ্বজুড়ে পরিচিত (যাদের বলা হতো “Amazonian Guard”)।


🕊 ১৩. ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ইসলামিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা:

ইসলামিক শাসন ও শরিয়াহ ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা ছিল তার অন্যতম উদ্দেশ্য।
মদ বিক্রি নিষিদ্ধ ছিল, নারী-পুরুষের সম্মান রক্ষা করা হতো।
ইসলামী ব্যাংকিং চালু করা হয়, সুদকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়।

মুআম্মার গাদ্দাফির আমলে লিবিয়া ছিল এক এমন দেশ যেখানে:

নাগরিকের কোনো ঋণ ছিল না শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান ছিল ফ্রি, যুবসমাজ চাকরি, ভাতা ও সম্মান পেত, আফ্রিকান রাষ্ট্রসমূহ তাকে নেতা হিসেবে মান্য করত, জনগণের হাতে প্রকৃত অর্থনীতি ও সম্পদ ছিল

তিনি  শুধু লিবিয়ার নয়, ছিলেন আফ্রিকা ও মুসলিম উম্মাহর এক প্রতীকি নেতা তার (বিষয়ে কিছু বিতর্ক থাকার পরও)। 

যাঁর শাসনকাল ছিল "একটি স্বপ্নময় বাস্তবতা", যা আজও লিবিয়ার মানুষ আফসোস করে স্মরণ করে।


🟩 পররাষ্ট্রনীতি ও মুসলিম উম্মাহর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি:

🔹 ফিলিস্তিন ইস্যুতে তিনি ছিলেন ইসরাইলের চরম বিরোধী এবং হামাস ও পিএলও’র সমর্থক।
🔹 আফ্রিকাকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন এবং একটি আফ্রিকান সোনার মুদ্রা চালুর পরিকল্পনা করছিলেন।
🔹 পশ্চিমাদের প্রতিটি আগ্রাসনমূলক পদক্ষেপের প্রতিবাদ করতেন, যেমন: ইরাক যুদ্ধ, আফগানিস্তান দখল ইত্যাদি।
🔹 মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে স্বাধীন, একীভূত ও শক্তিশালী জোট গঠনের আহ্বান জানান।

📘 গাদ্দাফির রচিত বই:

📙 “সবুজ বই” (The Green Book)
এই বইটি গাদ্দাফির রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সারসংক্ষেপ, যা তিনটি মূল ভাগে বিভক্ত:
1. সমাজ ও গণতন্ত্র (People's Authority)
2. অর্থনৈতিক ব্যবস্থা (Socialist Economy)
3. সমাজ ও সংস্কৃতি (Freedom, Family, Women)
এটি বিশ্বের বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং লিবিয়ার শিক্ষা ও প্রশাসনে একটি মৌলিক নীতিমালা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।




পশ্চিমা বিরোধিতা ও চ্যালেঞ্জ:

গাদ্দাফি পশ্চিমা বিশ্বের চোখে বিতর্কিত ব্যক্তি ছিলেন। পশ্চিমারা তাকে স্বৈরশাসক ও আন্তর্জাতিক জঙ্গি বলে অভিহিত করেছিল। ১৯৮০ ও ৯০ এর দশকে তার বিরুদ্ধে নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও সামরিক হুমকি দেখা দেয়। কিন্তু তিনি কখনো হাল ছাড়েননি এবং পশ্চিমা আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গেছেন।


গাদ্দাফির বিরুদ্ধে অভিযোগ :

গাদ্দাফির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ ছিল, সেগুলোকে  দুই ভাগে ভাগ করা যায়:


🟥 ১. আন্তর্জাতিক (পশ্চিমা বিশ্বের) দৃষ্টিতে অভিযোগসমূহ:

✅ ১.1. একনায়কতান্ত্রিক শাসন:

গাদ্দাফি ৪২ বছর ধরে একাই ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন। কোনও নির্বাচন, গণভোট বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ছিল না। পশ্চিমারা এটিকে "নির্মম একনায়কতন্ত্র" বলত।

📌 উদাহরণ:

দেশে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ছিল।

কেউ গাদ্দাফির বিরুদ্ধে কথা বললে গ্রেফতার বা গুম হয়ে যেত।

✅ ১.2. মানবাধিকার লঙ্ঘন:

তাঁর বিরুদ্ধে গোপন পুলিশ, টর্চার ও হত্যা-র অভিযোগ ছিল। বিরোধীদের ওপর নির্মম দমন চালাতেন।

📌 উদাহরণ:

১৯৯৬ সালে আবু সালিম জেলখানায় প্রায় ১২০০ বন্দিকে হত্যা করা হয়, যাঁরা সরকারের সমালোচনা করেছিল।

✅ ১.3. সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের অভিযোগ:

গাদ্দাফির বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে সাহায্য করার অভিযোগ তোলে আমেরিকা ও ইউরোপ।

📌 উদাহরণ:

১৯৮৮ সালের Lockerbie Bombing (স্কটল্যান্ডে একটি বিমানবোমা হামলা), যাতে ২৭০ জন মারা যায়—এর জন্য লিবিয়াকে দায়ী করা হয়।

পিএলও, আইআরএ, ও অন্য সশস্ত্র আন্দোলনে অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করতেন বলে অভিযোগ।

✅ ১.4. পরমাণু ও রাসায়নিক অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা:

পশ্চিমা বিশ্ব অভিযোগ করে গাদ্দাফি গোপনে পরমাণু ও রাসায়নিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছিলেন।

📌 ফলাফল:

২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের পর গাদ্দাফি চাপের মুখে এসব কার্যক্রম বন্ধ করে দেন এবং পশ্চিমাদের সহযোগিতা করতে সম্মত হন।


🟥 ২. লিবিয়ার জনগণের পক্ষ থেকে অভিযোগ:

✅ ২.1. বাকস্বাধীনতা হরণ:

গাদ্দাফির শাসনে কেউ কথা বললেই শাস্তি হতো। মিডিয়া ছিল পুরোপুরি সরকারি নিয়ন্ত্রণে।

📌 উদাহরণ:

কারও কাছে সরকারবিরোধী বই বা বক্তব্য পাওয়া গেলেই গ্রেফতার হতো।

ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদি এক সময় ব্লক করে দেওয়া হয়।

✅ ২.2. গোপন পুলিশ ও নজরদারি:

দেশে একটা ভয়ের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। জনগণ নিজের পরিবারের সামনেও কথা বলতে ভয় পেত।

✅ ২.3. ক্ষমতার উত্তরাধিকার তৈরি করার চেষ্টা:

গাদ্দাফি চেয়েছিলেন তাঁর ছেলে সাইফ আল-ইসলাম গাদ্দাফি-কে পরবর্তী শাসক বানাতে। এতে অনেক লিবিয়ান ক্ষুব্ধ হন।


ছবিটি ২০২১ সালের লিবিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় তোলা।

✅ ২.4. অর্থ বিতরণের বৈষম্য:

যদিও তেলের আয় থেকে অনেক সুযোগ ছিল, কিন্তু গাদ্দাফির পরিবার ও ঘনিষ্ঠরা অনেক বেশি সম্পদ ভোগ করত।

গাদ্দাফির বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো সত্য ছিল কি না—তা নিয়ে এখনো বিতর্ক আছে।

পশ্চিমা মিডিয়া গাদ্দাফির বিরুদ্ধে আরো একটি গুরুতর একটি অভিযোগ আনে


✅ "ধর্ষণকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার":

জাতিসংঘ ও পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়েছিল,
> গাদ্দাফি তার সেনাদেরকে "ধর্ষণ" করার নির্দেশ দিয়েছেন,
এমনকি যোদ্ধাদেরকে ভায়াগ্রা সরবরাহ করা হয়েছে যেন তারা "নারী বিদ্রোহীদের" ধর্ষণ করতে পারে।


🟡 কাদের মুখে এসব অভিযোগ উঠেছিল?

আমেরিকার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এবং নেটো জোটের নেতারা এসব অভিযোগ বারবার প্রচার করেছিল।
উদ্দেশ্য ছিল—গাদ্দাফিকে "দানব" প্রমাণ করে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপকে ন্যায়সঙ্গত করা।


🔎 এ সব অভিযোগের প্রমাণ ছিল কি?

❌ এই অভিযোগগুলোর প্রমাণ অত্যন্ত দুর্বল বা অনুপস্থিত ছিল:
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) প্রাথমিকভাবে এই অভিযোগ খতিয়ে দেখে,
কিন্তু এমন কোনও নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পায়নি যা আদালতে টিকতে পারে।
লিবিয়ার যুদ্ধ-পরবর্তী কিছু মানবাধিকার সংগঠনও খোলাখুলি স্বীকার করে,
যে এসব অভিযোগের বেশিরভাগ ছিল জল্পনা ও মিডিয়া মিথ্যাচার।

যুদ্ধের পর বহু রিপোর্টে বলা হয়, এসব অভিযোগ তথ্য-ভিত্তিক নয় বরং ছিল মানসিক যুদ্ধের অংশ (psychological warfare)।
যেমন:
Amnesty International এবং Human Rights Watch – দুটো সংস্থাই বলেছে:
> "We could not find solid evidence of mass rape used as a weapon of war in Libya."

🔻 গাদ্দাফির পতন ও নির্মম হত্যা: পরিকল্পিত একটি ষড়যন্ত্রের পরিণতি-

🔹 আরব বসন্ত: পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের শুরু:

২০১০ সালের শেষদিকে তিউনিসিয়ায় “আরব বসন্ত”  (Arab Spring) নামে এক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে, যা দ্রুত মিসর, ইয়েমেন, বাহরাইন, সিরিয়া এবং লিবিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। পশ্চিমা গণমাধ্যম এটিকে ‘গণতন্ত্রের জাগরণ’ নামে প্রচার করলেও বাস্তবে এটি ছিল একটি পরিকল্পিত সাম্রাজ্যবাদী প্রজেক্ট—মধ্যপ্রাচ্যের স্বাধীনচেতা নেতৃত্ব ধ্বংস করে ইসরাইল ও পশ্চিমাদের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ তৈরির অপচেষ্টা।

২০১০ সালের শেষদিকে তিউনিসিয়ায় “আরব বসন্ত”  (Arab Spring)  আন্দোলন

🔹 লিবিয়ায় “বিদ্রোহ” – কীভাবে শুরু হলো?

এক নায়ক তন্ত্র এবং দীর্ঘ ৪২ বছর ক্ষমতায় থাকার কারনে গাদ্দাফির প্রতি অনেকের  ক্ষোভ ছিল, আরব বসন্তের ঢেউয়ে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ফুসে ওঠে।

২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলের কিছু শহরে শুরু হয় “বিক্ষোভ”।

পশ্চিমা মিডিয়া এটিকে প্রচার করে “গণ-আন্দোলন” হিসেবে।

২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলের বিক্ষোভ

কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন—এই তথাকথিত বিক্ষোভকারীদের অনেকেই ছিল সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্য। বিক্ষোভ শুরু হতেই, অদ্ভুতভাবে তাদের হাতে পৌঁছে যায় ভারী অস্ত্র, গ্রেনেড লঞ্চার, এমনকি ট্যাংকও। 

যা স্পষ্ট করে—এই আন্দোলন স্পন্টেইনিয়াস ছিল না, ছিল সুপরিকল্পিত একটি সামরিক অভ্যুত্থান।

এরপর তারা বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা ও নিরাপত্তা চৌকিতে বোমা হামলা চালাতে থাকে। কিন্তু পশ্চিমা মিডিয়া অপপ্রচারে নামে— এই সন্ত্রাসী হামলাগুলোকেই তারা গাদ্দাফি সেনাবাহিনীর "জনগণের উপর বোমা বর্ষণ" বলে প্রচার করে। অর্থাৎ, হামলা করেছিল বিদ্রোহীরা, আর দোষ চাপানো হয় গাদ্দাফির সেনাদের ঘাড়ে!


🔹 পশ্চিমাদের ভূমিকাঃ ন্যাটো হামলার পেছনের ষড়যন্ত্র

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য দ্রুত “মানবাধিকার লঙ্ঘনের” অভিযোগ তুলে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ১৯৭৩ নম্বর প্রস্তাব পাস করায়, যার মাধ্যমে লিবিয়ায় নো-ফ্লাই জোন তৈরি এবং পরে বোমা বর্ষণের অনুমতি দেয়া হয়। বাস্তবে এটি ছিল একটি বিমান-আক্রমণ ভিত্তিক যুদ্ধ ঘোষণার চুক্তি। ন্যাটো বাহিনী লিবিয়ার সামরিক ঘাঁটি, সরকারি অফিস, এমনকি হাসপাতাল ও স্কুলে পর্যন্ত হামলা চালায়।

গাদ্দাফির রাজধানী ত্রিপোলি পশ্চিমা সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্রোহীদের হাতে চলে যায় আগস্ট ২০১১-তে।




🔹 পশ্চিমাদের যুক্তি ছিল কী?

পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে আমেরিকা, ফ্রান্স, ব্রিটেন এবং তাদের মিত্ররা বলেছিল:

1. গাদ্দাফি নিজ দেশের নাগরিকদের উপর নিষ্ঠুরভাবে হামলা চালাচ্ছেন — বিশেষ করে যখন ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় লিবিয়ার বিভিন্ন শহরে সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়।

2. গাদ্দাফি "গণহত্যা" ঘটাতে পারেন — এই আশঙ্কা দেখিয়ে বলা হয়েছিল, বেনগাজি শহরের বিক্ষোভকারীদের গাদ্দাফির সেনারা দমন করতে যাচ্ছে, এবং এতে বড় ধরনের গণহত্যা হতে পারে।

3 জাতিসংঘের অনুমোদন ছিল — জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ Resolution 1973 পাস করেছিল, যেখানে বলা হয়েছিল:

লিবিয়ার আকাশসীমায় নো-ফ্লাই জোন ঘোষণা করা হবে।

নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য প্রয়োজন হলে সামরিক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।

এটা দেখিয়ে পশ্চিমারা জনগণের কাছে বলেছিল, “আমরা গাদ্দাফিকে সরাতে নয়, বরং নাগরিকদের রক্ষা করতে যাচ্ছি।” 


🔸 বাস্তবে কী ঘটেছিল?

গাদ্দাফির সেনাবাহিনীর উপর বিমান হামলা চালানো হয়।

বিদ্রোহীদের সহায়তা দেওয়া হয় অস্ত্র এবং তথ্য দিয়ে।

🔹 অনেক বিশ্লেষক বলেন:

মানবাধিকার রক্ষা ছিল একটি অজুহাত মাত্র, আসল লক্ষ্য ছিল:

🟥 ১. তেল ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ:

লিবিয়া ছিল আফ্রিকার অন্যতম ধনী তেলসম্পদধারী দেশ (বিশ্বের ৯ম বৃহৎ রিজার্ভ)। গাদ্দাফি পশ্চিমাদের তেল কোম্পানিগুলোকে কঠিন শর্তে চুক্তি দিতেন এবং দেশের সম্পদ জাতীয়করণে বিশ্বাসী ছিলেন।

গাদ্দাফির পতনের পর পশ্চিমা বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তেল ও গ্যাসের চুক্তিতে বিশেষ সুবিধা পেতে থাকে, এবং লিবিয়ার সম্পদে ব্যাপক হারে হস্তক্ষেপ করে।


🟥 ২. গাদ্দাফির স্বর্ণ-ভিত্তিক ‘আফ্রিকান মুদ্রা’ পরিকল্পনা:

গাদ্দাফি চাচ্ছিলেন একটি স্বর্ণভিত্তিক ‘আফ্রিকান দিনার’ চালু করতে, যার মাধ্যমে আফ্রিকার দেশগুলো ডলার ও ফ্রাঙ্ক ছেড়ে নিজেদের মুদ্রায় লেনদেন করতে পারবে। এটা পশ্চিমা অর্থনৈতিক আধিপত্যের জন্য হুমকি ছিল।

গাদ্দাফির মৃত্যুর পর সেই পরিকল্পনা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে ডলার ও ইউরোই আফ্রিকায় প্রাধান্য ধরে রাখে, আর পশ্চিমা ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিরাপদ থাকে।


🟥 ৩. আফ্রিকায় গাদ্দাফির প্রভাব কমানো:

গাদ্দাফি ছিলেন আফ্রিকান ইউনিটি ও ইসলামী নেতৃত্বের পৃষ্ঠপোষক। তিনি অসংখ্য আফ্রিকান দেশে বিনিয়োগ করছিলেন, এবং পশ্চিমা আধিপত্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করছিলেন।

গাদ্দাফি মারা যাওয়ার পর আফ্রিকান দেশগুলোর স্বাধীন নেতৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়ে, পশ্চিমারা নতুন করে সেখানে নরম উপনিবেশবাদ চালু করে (যেমন: ফ্রান্স ও আমেরিকার সেনাঘাঁটি)।


🟥 ৪. মুসলিম বিশ্বে স্বাধীন নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত ভাঙা:

গাদ্দাফি ছিলেন এমন একজন মুসলিম শাসক, যিনি আমেরিকা ও পশ্চিমা জোটকে খোলাখুলি সমালোচনা করতেন। তাঁর মতো “স্বাধীনচেতা শাসকের” দৃষ্টান্ত বাকি মুসলিম দেশগুলোকে সাহস দিচ্ছিল।

তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে পশ্চিমারা একটি বার্তা দেয়—

“যদি কেউ আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তার পরিণতি হবে গাদ্দাফির মতো।” এতে অনেক মুসলিম দেশ নতজানু হয়ে পড়ে।


🟥 ৫. লিবিয়াকে অস্থিতিশীল করে "সন্ত্রাসের ঘাঁটি" বানানো:

স্থিতিশীল গাদ্দাফিশাসিত লিবিয়া ছিল ইউরোপ-আফ্রিকার মাঝখানে এক গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তাবলয়। তাঁকে সরিয়ে দিয়ে তারা চায়, লিবিয়া যেন বিশৃঙ্খল হয় এবং সেখানে সন্ত্রাস, অস্ত্র পাচার, মানব পাচার চলতে পারে।

আজ লিবিয়া: দুভাগে বিভক্ত একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র ইউরোপে মানব পাচারের রুট , আফ্রিকায় অস্ত্র ছড়ানোর কেন্দ্র, এতে নতুন নতুন যুদ্ধের অজুহাতে পশ্চিমারা সেখানে সেনা পাঠাতে পারে ও দখল বজায় রাখে।


🟥 গাদ্দাফির মৃত্যুদণ্ড ও নির্মম হত্যা:

২০ অক্টোবর ২০১১: গাদ্দাফি তার নিজ শহর সিরতের কাছাকাছি গাড়িবহরে অবস্থান করছিলেন, যেখানে ন্যাটো ড্রোন ও ফরাসি যুদ্ধবিমান তার গাড়িবহরে বোমা বর্ষণ করে।




আহত অবস্থায় তিনি একটি ড্রেন পাইপে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে পশ্চিম-সমর্থিত বিদ্রোহীরা তাকে ধরে ফেলে এবং বিশ্বের ক্যামেরার সামনে গুলি ও নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যার দৃশ্য ধারণ করে—যা মানবাধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘন।

কোনো আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল বা আইনগত প্রক্রিয়া ছাড়াই তাকে হত্যা করা হয়, যা ছিল অবৈধ হত্যাকাণ্ড (extrajudicial killing)।


🔹 নোট: কারা ছিল পেছনে?

যুক্তরাষ্ট্র:

প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রকাশ্যেই গাদ্দাফির পতনকে "লিবিয়ার জন্য বিজয়" বলে উল্লেখ করেছিলেন। CIA পূর্ব লিবিয়ায় গোপনে অস্ত্র সরবরাহ ও বিদ্রোহী সংগঠনের সহায়তায় কাজ করেছিল।

ফ্রান্স:

ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি-ই প্রথম গাদ্দাফির বিরুদ্ধে ন্যাটো হামলার দাবি তোলে।

গোপন তথ্য মতে, গাদ্দাফি ২০০৭ সালে সারকোজির নির্বাচনী প্রচারে অর্থ সহায়তা দেন—এই তথ্য প্রকাশ হয়ে যাওয়ার আগেই গাদ্দাফিকে সরিয়ে ফেলা ফ্রান্সের জন্য জরুরি ছিল।


যুক্তরাজ্য ও ন্যাটো:

ন্যাটো বোমা হামলার নেপথ্যে ছিল যুক্তরাজ্য ও ইতালি, যারা লিবিয়ার তেল রিজার্ভে আগ্রহী ছিল।

গাদ্দাফি আফ্রিকান ইউনিয়ন ও স্বর্ণ-ভিত্তিক মুদ্রা চালুর পরিকল্পনা করেছিলেন, যা ডলার ও ইউরোর আধিপত্যকে হুমকির মুখে ফেলতো। এই কারণেও তাকে সরিয়ে ফেলা হয়।

🟥 গাদ্দাফির পতনের পর লিবিয়ার অবস্থা:

সে সময় পশ্চিমারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও লিবিয়ার জনগণের সামনে কিছু আকর্ষণীয় প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাস উপস্থাপন করেছিল। এইসব প্রতিশ্রুতি ছিল মূলত প্রোপাগান্ডামূলক—যেগুলোর  কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি।


🔹 ১. গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি

পশ্চিমারা বলেছিল, গাদ্দাফির স্বৈরশাসনের অবসান হলে লিবিয়ায় প্রকৃত গণতন্ত্র আসবে। জনগণ পাবে ভোটাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং আইনের শাসন।

➡ বাস্তবে: গাদ্দাফির মৃত্যুর পর লিবিয়া বারবার বিভক্ত হয়েছে—দুই বা ততোধিক সরকারের দখলে দেশ। এখনও তথাকথিত 'সুসংগঠিত নির্বাচন' বা 'প্রকৃত গণতন্ত্র' আসেনি


🔹 ২. মানবাধিকার রক্ষার আশ্বাস

তারা দাবি করেছিল, গাদ্দাফি মানবাধিকার লঙ্ঘন করতেন। তাই তাঁর পতনের পর জনগণ নিরাপদ ও মর্যাদার জীবন পাবে।

➡ বাস্তবে: গাদ্দাফির মৃত্যুর পরপরই বন্দি নির্যাতন, গুম, মানব পাচার, ধর্ষণ ও নিপীড়নের মাত্রা ভয়ংকরভাবে বেড়ে যায়। জাতিসংঘও একে মানবিক বিপর্যয় বলেছে।


🔹 ৩. অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি

তারা বলেছিল, পশ্চিমা সহযোগিতায় লিবিয়ার অর্থনীতি হবে আরও শক্তিশালী; তেল সম্পদ কাজে লাগবে জনগণের উন্নয়নে।

➡ বাস্তবে: গাদ্দাফির সময়কার বিনামূল্যের বিদ্যুৎ, চিকিৎসা ও শিক্ষার ব্যবস্থা উঠে যায়। আজ দেশ অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত—বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি আর অনিরাপত্তা সর্বত্র।


🔹 ৪. শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি
পশ্চিমা প্রচার বলেছিল, গাদ্দাফির পতনের পর লিবিয়া শান্তির পথে হাঁটবে, মিলিশিয়া ও সহিংসতা কমে আসবে।
➡ বাস্তবে: দেশটি বহু বছর ধরে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত। নানা মিলিশিয়া গোষ্ঠীর লড়াইয়ে আজও হাজারো মানুষ বাস্তুচ্যুত। শান্তির চেয়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদের রাজনীতি চলছে।


🔹 ৫. মানবিক সহায়তা ও পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি
তারা বলেছিল, গাদ্দাফির পতনের পর দেশ পুনর্গঠন করা হবে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামোতে উন্নয়ন আসবে।
➡ বাস্তবে: পশ্চিমারা শুধু তেল ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ নিয়েছে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত বহু শহর এখনও পুনর্গঠনের অপেক্ষায়।

পশ্চিমারা ‘স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও উন্নয়নের স্বপ্ন’ দেখিয়ে গাদ্দাফিকে সরিয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে তারা লিবিয়াকে শোষণ, সন্ত্রাস ও বিশৃঙ্খলার এক মঞ্চে পরিণত করেছে।

শত শত মিলিশিয়া গোষ্ঠী দেশটিকে নিয়ন্ত্রণ করে, চরম নিরাপত্তাহীনতা, অর্থনৈতিক পতন, অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ, 

জনসাধারণ খাদ্য, জ্বালানি, বিদ্যুৎ—প্রায় সবকিছুর জন্য সংগ্রাম করছে,

২০১১ সালের আগের শান্তি, সমৃদ্ধি ও জাতীয় ঐক্যের দিনগুলোকে আজও লিবিয়ানরা স্মরণ করেন কষ্টের সাথে। পশ্চিমারা বলেছিল, “আমরা গাদ্দাফিকে থামাতে চাই কারণ তিনি নিজের নাগরিকদের হত্যা করছেন।” 

পশ্চিমাদের স্বপ্ন তো পূরণ হলো কিন্তু লিবিয়াদের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল বরং তা দুঃস্বপ্নে পরিণত হলো

🔸 নোট:

গাদ্দাফির পতন কোনো স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিণতি ছিল না—এটি ছিল পশ্চিমাদের একটি নিষ্ঠুর ও সুপরিকল্পিত হত্যা প্রকল্প, যার উদ্দেশ্য ছিল:

লিবিয়ার স্বাধীনতার চূড়ান্ত অবসান , গাদ্দাফির আদর্শ ও সাহসিকতার মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বের জাগরণকে থামিয়ে দেয়া.

মুআম্মার গাদ্দাফি ছিলেন এক বিপ্লবী, স্বাধীনতাকামী নেতা। তার শাসন ছিল দৃঢ়, কিন্তু জনকল্যাণমুখী। তিনি মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন এবং আফ্রিকাকে একটি শক্তিশালী জোটে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। আজ তাঁর অনুপস্থিতিতে লিবিয়া যেমন দুর্দশায় পতিত, তেমনি মুসলিম বিশ্ব হারিয়েছে এক সাহসী কণ্ঠস্বর।

তিনি  শুধু লিবিয়ার নয়, ছিলেন আফ্রিকা ও মুসলিম উম্মাহর এক প্রতীকি নেতা। যাঁর শাসনকাল ছিল "একটি স্বপ্নময় বাস্তবতা", যা আজও লিবিয়ার মানুষ আফসোস করে স্মরণ করে।

> আজ কোটি লিবিয়ানের কণ্ঠে এই আফসোস:

"আমরা যা হারিয়েছি, তা এখন আর ফিরে পাবো না—গাদ্দাফির মতো নেতৃত্ব আর আসবে না।"






Ofde islam
সাআদ ✔ Verified
Founder | Creative Lead - বাংলাদেশ



                   




Post a Comment

0Comments

Thanks everyday

Post a Comment (0)
To Top